‘এবার ঈদ যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম’
অন্য বছরের তুলনায় এবার ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কম ঘটেছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদ যাত্রায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কম হয়েছে বলে মনে করছে বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এমন বক্তব্য পাওয়া গেছে।
এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরে গত ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ দিনে রাজধানী শহর ঢাকা ছেড়েছেন এক কোটির বেশি মানুষ। এসব মানুষ বাস, রেল, লঞ্চসহ নিজস্ব যানবাহন ও মোটরসাইকেলে করে তাদের গন্তব্যে গেছেন।
অনেকেই ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে ফিরে আসছেন কর্মস্থলে। সোমবার (২৪ এপ্রিল) খুলেছে সরকারি অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ঢাকায় ফিরতি মানুষের বেশ চাপ পড়েছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে।
দীর্ঘ ছুটি ও সড়ক মহাসড়কগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তীক্ষ্ণ নজরদারির কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রামে ঈদ করতে যাওয়া মানুষের যাতায়াত এবার তুলনামূলক স্বস্তির হয়েছে। তবে ফেরার পথে চাপ অনেকটা বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। একই সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন যেভাবে তৎপর ছিল ফিরতি পথেও যদি তৎপর থাকে তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে বলে মন্তব্য সংগঠনগুলোর। এর ব্যতিক্রম হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা ঈদযাত্রার দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩ হাজার ৮৭৭ জন। গত ছয় বছরে ঈদুল ফিতরের ঈদ যাত্রায় মারা যান ১ হাজার ৯৭৯ জন। ঈদুল আজহার ঈদ যাত্রায় মারা যান ১ হাজার ৮৯৮ জন।
২০২২ সালে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৩ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে সারা দেশে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত হয়, ৭৭৪ জন আহত হয়। সে সময় দুর্ঘটনার শীর্ষে ছিল মোটরসাইকেল। ১১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয় ৬৮ জন আহত হয়। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং নিহত ৩২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এ ছাড়া, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ২০২২ সালে ঈদ যাত্রায় ৩৭২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৪১৬ জন এসময় আহত হয় ৮৪৪ জন। এরমধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৪৫ জন।
২০২৩ সালে ঈদুল ফিতরের আগে দীর্ঘ ছুটি, স্কুল-কলেজ আগেই বন্ধ, ফিটনেস বিহীন গাড়ি না চলতে দেওয়া এবং মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কঠর নজরদারির কারণে অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হয়েছে সড়কে দুর্ঘটনা।
এবার ঈদের ছুটি শুরুর আগেই অনেকে গ্রামে চলে যাওয়ার কারণে মহাসড়কগুলোতে এবছর যানজটের সংখ্যা ছিল কম। এসব বিষয় মাথায় রেখে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ অনেকাংশেই সম্ভব হবে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, হাইওয়েতে বিশেষ করে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে প্রশাসন যেভাবে মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা জারি রেখেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন করা গেলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বিশেষ করে মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি থাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা মহাসড়কগুলোতে কমানো সম্ভব হয়েছে। তবে ঈদের আগে এবং ঈদের দিন আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সড়কগুলোতে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়েছে।
ঈদ শেষে গ্রাম থেকে ফেরা মানুষগুলোর যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর থাকতে হবে তাহলে ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন রোড সেফটির এই নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, আর যদি সেটা না হয় তাহলে ফিরতি মানুষের দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লেন এবং গতি নিয়ন্ত্রণ করে চালাতে হবে তা না হলে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই ভয় থেকে অনেকেই গতি নিয়ন্ত্রণ করে পদ্মা সেতু অতিক্রম করেছেন। আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব জাগ্রত করার জন্য ভয়ের সৃষ্টি না করলে আমরা কেউ সচেতন হই না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দুর্ঘটনার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। ঈদের ছুটি শেষে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং সড়কের মৃত্যুর বিষয় সম্পর্কে আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারব। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কম হয়েছে বলে ধারণা করছি। যারা বাড়ি গিয়েছে ঈদ করতে এবং ঈদ শেষে যারা কর্মস্থলে ফিরবেন তাদের যাত্রা পথে যান চলাচলের বিষয়ে নজরদারি রাখলে দুর্ঘটনা এই বছর বহুগুণ কম হবে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমান বলেন, ঈদ করতে যারা গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন এবং ঈদ শেষে যারা সড়ক পথে, নৌ পথে ও রেলপথে ঢাকায় বা তাদের কর্মসংস্থানে ফিরবেন তারা যদি একটু সতর্ক হন তাহলে এবার সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটা কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সড়কে এবং বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট। সবাইকে আইন মেনে চলাচলের জন্য অনুরোধ করছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারের অতিরিক্ত উপকমিশনার নিয়তি রায় বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে ডিএমপির সব ইউনিট কাজ করছে। তবে এবার ঈদের আগে রাজধানীতে অনেকটা সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কম হয়েছে। ট্রাফিক বিভাগ অনেকটা স্বচ্ছভাবে রাস্তায় যান চলাচলে সহযোগিতা করেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সড়কের দুর্ঘটনা নিয়ে যে সমস্ত সংস্থা জরিপ করে তাদের দেওয়া তথ্য মতে এবার সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটা কম। তবে মহাসড়কে কম হলেও মফস্বলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ একটু বেশি। এবার ঈদ যাত্রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে সড়কে, মহাসড়কে এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক ছিলেন ঠিক কর্মজীবী মানুষ তাদের গন্তব্যে ফেরার পথে যদি এমনটা সতর্ক হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটা কম হবে এবং কমে আসবে।
তিনি বলেন, তবে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থেকে চলাচল করতে হবে। নিজে দায়িত্ব নিয়ে সতর্ক থেকে চলাচল করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
কেএম/এসএন