ডিসেম্বরে সাগর থেকে পাইপ লাইনে ক্রুড পরিবহন শুরুর প্রত্যাশা
গভীর সাগর থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় জ্বালানি তেলের স্টোরেজ ট্যাঙ্কে তেল খালাস হবে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি। দিনে গড়ে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাস হবে এই পাইপ লাইনে। ৬ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য পাইপ লাইন স্থাপনের কাজও এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল খালাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সাশ্রয় হবে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে তেল খালাস করে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হবে না।
এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (বিপনন) অনুপম বড়ুয়া বুধবার সকালে (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পাইপ লাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বা ক্রুড অয়েল পরিবহনের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্প কাজ শেষ হবে বলে জানা আছে। এতে দুই ধরনের উপকার হবে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে ক্রুড পরিবহন হলে অপারেশনস লোকসান কমবে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ক্রুড পরিবহন ব্যয়ও কমবে বিপিসির।
বিপিসি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ক্রুড পরিবহন হচ্ছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দুই লাইটার ট্যাংকার ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ ও ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’র মাধ্যমে। এতে বিপিসির অপারেশনস লোকসান বাবদ বিপুল ক্ষতি হতো। আবার বিএসসিকে ক্রুড পরিবহন বাবদ প্রতি মাসে বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হতো। মূলত পরিবহন ও অপারেশনস খাতে অর্থ সাশ্রয় করতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ক্রুড পরিবহন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্পের সুফল পাওয়ার সময় এখন কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পাইপ লাইনে ক্রুড পরিবহন করতে নেওয়া প্রকল্পটির নাম ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প। প্রতি মাসে বিপিসি ১ লাখ টন ক্রুড আমদানি করে। এসব ক্রুডবাহী বৃহদাকার মাদার অয়েল ট্যাংকার নোঙর করে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করতে পারে না। মাদার ট্যাংকারে করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হয় ক্রুড। পাইপ লাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে অবস্থানকারী ১ লাখ টন ধারণ ক্ষমতার মাদার ট্যাংকার দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) জ্বালানি তেল নিয়ে আসা হবে। রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাংকেই ভর্তি করা হবে পাইপ লাইনে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে গড়ে ৭০ লাখ টনের কাছাকাছি জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এরমধ্যে ১২ লাখ টন থেকে ১৫ লাখ টনের মতো ক্রুড বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়। বাকি আমদানি তেলের সবই পরিশোধিত অবস্থায় আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয় এসব পরিশোধিত জ্বালানি তেল। গড়ে ১ লাখ টন অয়েল ট্যাংকার কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাংকে নিয়ে আসা হয়। এই খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বছরে গড়ে ৮০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়।
এ ছাড়া ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে গড়ে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। এক একটি মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে খালাস প্রক্রিয়া শেষ করতে লাগত ১১/১২ দিন। এসময়ের জন্য জাহাজ মালিককে বিপুল ভাড়া পরিশোধ করতে হতো বিপিসিকে। এ ছাড়া মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে লাইটারেজ করার সময় জ্বালানি তেল অপচয় ও নষ্ট হয়। বহু তেল চুরিও হয়। এভাবে বিপিসি প্রচুর সিস্টেম লসের কবলে পড়ে। এ ধরনের কঠিন সংকট কাটাতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চীনের এক্সিম ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ করবে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর ও অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। এরমধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন। বর্তমানে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে।
কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গার উপর ৬টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ৬টি স্টোরেজ ট্যাংকের ৩টিতে পরিশোধিত এবং অপর ৩টিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুদ করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।
জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত তেল সরাসরি ভেসেল মুরিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখান থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুনরায় পাম্পের মাধ্যমে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে। ডাবল পাইপ লাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপর পাইপ লাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল সরবরাহ করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির কাজ আরও অনেক আগে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে মেয়াদ বৃদ্ধি হয়। তিন দফা সংশোধন করে আগামী বছরের (২০২৩ সাল) জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটির ব্যয় ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিপিসির অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
ইআরএলের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে অনেক পুরোনো পদ্ধতিতে বন্দর বহির্নোঙর থেকে জ্বালানি তেল খালাস করা হয়। এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুলও। গভীর সমুদ্রে মুরিং পয়েন্ট নির্মাণ ও পাইপ লাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস সর্বাধুনিক পদ্ধতি। এতে নিরাপদ ও কম ব্যয়ে পরিবহন হবে জ্বালানি তেল।
এসএন