দোকানে দোকানে দালাল!
‘রিনু (রিনিউ) নাকি নতুন?’, ফরম ফিলআপ করবেন?’ বা ‘ফটোকপি লাগব?’ ছোটখাটো এমন প্রশ্নে সম্ভাব্য খদ্দেরদের মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন মোহাম্মদ সবুজ। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তর সংলগ্ন সংস্কারাধীন মূল সড়কের পাশে তার অস্থায়ী দোকান।
পাসপোর্ট সংক্রান্ত সম্ভাব্য সেবাগ্রহীতা সেজে এই প্রতিবেদক জবাব দিলেন তার প্রশ্নের। বললেন, নতুন পাসপোর্ট করাব। সবুজ জানালেন, কত বছর মেয়াদের বা কত পৃষ্ঠার পাসপোর্ট করতে সরকারি খরচ কত। নির্দিষ্ট ফরম ফিলআপ করে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে।
তবে ২০০ টাকা দিলে তিনিই ফর্ম ফিলআপ করে দেবেন। আরও ২০০ টাকা দিলে তিনি টাকা জমার ব্যবস্থাও করে দেবেন। ব্যাংকে যেতে হবে না। তিনি জমার স্লিপ দিয়ে দেবেন।
আনুষঙ্গিক আরও প্রশ্ন করে সবুজ নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলেন সত্যিকারের খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলছেন কিনা। ইতিবাচক ভেবে কথা আরেকটু এগোলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট পেতে চাইলে বাড়তি টাকা লাগবে। জানতে চাইলে বললেন, এটা সরকারি ফি না, তাই স্লিপ পাওয়া যাবে না। অধিদপ্তর ভবনের দিকে দেখিয়ে বললেন, এটা বড় স্যারদের জন্য।
কিন্তু বড় স্যাররা কি আর যারতার কাছ থেকে টাকা নেবেন? এই কথার জবাবে সবুজ বললেন, তিনিই স্যারদের হাতে টাকা পৌঁছে দেবেন। তিনি নিয়মিতই তাই করেন।
প্রতিবেদক এবং তার স্ত্রী ও দুই সন্তান মিলে চারটি পাসপোর্টের সরকারি ফি, ফরম ফিলআপ এবং ব্যাংকে জমার চার্জ ছাড়াও বড় স্যারদের জন্য ১১ হাজার টাকা বাড়তি দিলে ২১ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পৌঁছে দেবেন বলে নিশ্চয়তা দেন সবুজ। টাকা-পয়সার জোগাড় করে ফোন (০১৭৬৫৭২৬১৫৩) দিতে বলে বিদায় দেন তিনি।
তবে সবুজ একা নন। সংস্কারাধীন সড়কের দুই পাশেই সারি সারি এসব দোকানে ফরম ফিলআপ করা বা ফটোকপির দোকানের নামে ওঁত পেতে থাকে দালালরা। তাদের আরেকজন এনায়েত হোসেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বললেন, ব্যাংক জমার স্লিপ ও সব কাগজ-পত্র জমা দেওয়ার পর ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার জন্য একটা তারিখ দেওয়া হবে।
ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার পর ২১ দিন গণনা করা হয়। ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য তারিখ পেতেই মূলত মাসের পর মাস কেটে যায়। তবে দেড় হাজার টাকা দিলে তিনি ২/৩ দিনের মধ্যেই ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার জন্য তারিখ এনে দেবেন। চারটি পাসপোর্টের সব মিলে খরচের একটা ধারণা দিয়ে আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে ফোন (০১৭১৮৯৭৭৭২২) দিতে বলেন তিনি।
আরেক দালাল ফজলুল হাসান ফোন নাম্বার (০১৬৭২১৯৮০৮০) দিয়ে বললেন, আপনার যেহেতু একসাথে চারটি পাসপোর্ট। তাই খরচ কমিয়ে নেব। যখন পাসপোর্ট করাবেন, তখন দেখব।
তাদের আরেকজন ইব্রাহিম খলিল ফোন নাম্বার (০১৬৮৪৪০৪৯৩৩) দিয়ে বললেন, সব জিনিসেরই দাম বেশি। তাই খরচ একটু বেশি নিচ্ছেন। উপরে নিচে সব জায়গায় দিয়ে, তার আর তেমন কিছু থাকে না। তবে যখন কাজ করাবে, তখন আরও কমিয়ে নেবেন।
০১৭৭৯৯৪১৪৬৯ নাম্বারটি দিয়ে সায়েদুল্লাহ সারি বাঁধা দোকানগুলোর আশপাশে পায়চারিরত সেনা ও আনসার সদস্যদের দিকে ইশারা করে বললেন, সবাইকেই তো খরচ দিতে হয়, এদের মাধ্যমে উপরের স্যারদের কাছে টাকা-পয়সা পাঠাই, তাই এদেরও তো ঠিক রাখতে হয়, সবমিলে খরচ অনেক। তাই একটু বেশি নিতে হয়।
তবে এসব দালালের খপ্পরে পড়ে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও ঘুরতে হয় ভূক্তভোগীদের। ভূক্তভোগেীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা ছুঁতায় বারবার খরচ দিতে হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান সময়মতো হয় না। আবার দালালকে এড়িয়ে চলার সুযোগও থাকে না ভূক্তভোগীদের।
তাদের একজন তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন। তিনি বললেন, প্রায় এক বছর হয়ে গেল দালাল আমার পাসপোর্ট দিচ্ছে না। আমার পুরোনো পাসপোর্টসহ বিভিন্ন কাগজ-পত্র তার কাছে। এখন তার কাছ থেকে সরতেও পারছি না।
তিনি জানান, দালালের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আরও অনেক ভূক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। বললেন, এরা ফর্ম ফিলআপ করার সময়ই ইচ্ছাকৃত কিছু ভুল করে রাখে। যেন পরে এটা সংশোধনের ছুঁতায় বারবার টাকা নিতে পারে।
এমএ/এমএমএ/