১২ দিনের ঈদযাত্রায় সড়কে ৩২৪ মৃত্যু
ঈদে বাড়ি যাওয়া ও ঈদের পর কাজে ফেরার যাত্রায় ৫ থেকে ১৬ জুলাই মোট ১২ দিনে সড়কে ঝরেছে ৩২৪ প্রাণ। এই ১২ দিনে সড়কে দুর্ঘটনা হয়েছে ১ হাজার ৯৫৬ টি যাতে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৬১২ জন।
রবিবার (১৭ জুলাই) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য রোড-এর এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২৪ টি জাতীয় দৈনিক, ১৭ টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ২১ টি টিভি-চ্যানেলের পাশাপাশি সংগঠনটির চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম, প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদীসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবকদের তথ্যে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ থেকে ১৬ জুলাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে ৪১৮টি যাতে আহত হয়েছেন ৩৬৮ জন ও নিহত হয়েছেন ৫৫ জন; ট্রাক দুর্ঘটনা হয়েছে ৫০২টি যাতে আহত হয়েছেন ১৭৪ জন ও নিহত হয়েছেন ৮৮ জন; বাস দুর্ঘটনা হয়েছে ৫১১টি যাতে আহত হয়েছেন ৬৩৬ জন ও নিহত হয়েছেন ১০২ জন এবং অন্যান্য বাহনের দুর্ঘটনা হয়েছে ৫২৫টি যাতে আহত হয়েছেন ৪৩৪ জন ও নিহত হয়েছেন ৭৯ জন।
প্রতিবেদনে শান্তা ফারজানা বলেন, প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ ঈদযাত্রা এবং বাড়ি ফেরত মানুষের মধ্যে ৯৬ লক্ষ মানুষ সড়ক- রেল ও নৌপথে চরম ভোগান্তি সহ্য করে ২ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করেছে এবার। বাকি ২৯ লক্ষ মানুষ নিজস্ব বাহন বা অন্য কোন আরামদায়ক বাহনে যাতায়াত করলেও রেলের ছাদে চড়ে বাড়িতে গিয়েছে অর্ধ লক্ষ মানুষ। তবুও সহ্য করতে হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের লাঠির আঘাত, থাকতে হয়েছে বগিতে বন্দী দিনের অধিকাংশ সময়। ছিলো মোটর সাইকেলের ‘মুভমেন্ট পাশ’ নাম উদ্ভট সিদ্ধান্তও। মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথে যেতে না পারায় অনেককে পরতে হয়েছে এ্যাম্বুলেন্স-মাইক্রোবাস-ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার এমনকি কোরবানীর পশুবহনকারী পিকআপ-ভ্যান-ট্রাকের পাল্লায়ও। এসব বাহনে নির্মমভাবে কোরবানীর পশুর মত গাদাগাদি করেও বাড়িতে যেতে হয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষকে। দ্রুত গতিতে মোটর সাইকেল চালানোর পাশাপাশি নিয়ম না মানা এবং হেলমেট ব্যবহারে অনীহার কারণে ৪১৮ টি দুর্ঘটনায় আহত ৩৬৮ এবং নিহত হয়েছে ৫৫ জন; যার অধিকাংশই বাইক লেন না থাকার কারণে প্রাইভেট কার, ট্রাক, বাস-মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন বাহনের পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার কারণে ঘটেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোন রকম বিরতি না নিয়ে টানা ট্রাক চালানোর কারণে অসাবধানতা ও ঘুমন্ত চোখে-ক্লান্তি থাকায় প্রসূতি মায়ের মত ৮৮ জন নিহত হয়েছেন ৫০২ টি দুর্ঘটনায়; আহত হয়েছেন ১৭৪ জন। চরমভাবে অচল রাস্তা-ঘাট আর সড়কপথ নৈরাজ্যের কারণে ৫১১ টি বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬৩৬ জন এবং নিহত হয়েছেন ১০২ জন; পাড়া-মহল্লা-মহাসড়কে অসাবধানতার সাথে চলাচলের কারণে লরি-পিকআপ-নসিমন-করিমন-ব্যাটারি চালিত রিকশা-বাইসাইকেল ও সিএনজি দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫২৫ টি আহত হয়েছেন ৪৩৪ জন এবং ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও ৫ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত নৌপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬ টি। আহত ১২৭ জন, নিহত হয়েছেন ১৭ জন; প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ রেলপথে চরম ভোগান্তি সহ্য করে চলাচলে যেমন ভোগান্তি সহ্য করেছে, ছাদ থেকে পরে, অসচেতনতা বশত রেল ক্রসিং-এ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১২২ টি। আহত হয়েছে ২১২ জন, নিহত হয়েছে ১১ জন। আকাশপথে দুর্ঘটনা ঘটলেও যাত্রী না থাকায় কোন নিহত নেই, তবে ১ টি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের দুটি বিমান, আহত হয়েছেন ৩ জন। এছাড়াও বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনার কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে ২৭ জনকে।
সেভ দ্য রোড-এর গবেষণা সেল-এর তথ্যে আরও উঠে এসেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে গত ১২ দিনে ২১ টি দুর্ঘটনার কথা। এতে আহত হয়েছেন ২৭ জন।
মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধের বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৩৭ লক্ষ ৫৩ হাজার নিবন্ধিত মোটর সাইকেল-এর মালিক; যারা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বকে সমৃদ্ধ করছে। তাদের কথা বিবেচনায় রেখে বাইক লেন-এর দাবিতে রাজপথে থেকেছে সেভ দ্য রোড। যৌক্তিক বিবেচনায় বাইকের বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার-ই হবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জন্য কল্যাণকর সিদ্ধান্ত।
২০০৭ সাল থেকে দুর্ঘটনামুক্ত পথের জন্য ৭ টি দাবি জানিয়ে আসছে সেভ দ্য রোড।
১. বঙ্গবন্ধু ফুটবল লীগের খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়কপথ দুর্ঘটনায় নিহত অর্ধশত শিশু-কিশোর-এর স্মরণে ১১ জুলাইকে ‘দুর্ঘটনামুক্ত পথ দিবস’ ঘোষণা করা।
২. ফুটপাত দখলমুক্ত করে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধা দেওয়া ও বাইক লেন-এর ব্যবস্থা করা।
৩. সড়কপথ পথে ধর্ষণ-হয়রানি রোধে ফিটনেস বিহীন বাহন নিষিদ্ধ এবং কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যতিত চালক-সহযোগি নিয়োগ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. স্থল-নৌ-রেল ও আকাশ পথ দুর্ঘটনায় নিহতদের সরকারিভাবে কমপক্ষে ১০ লাখ ও আহতদের ৩ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ দেওয়া।
৫. ‘ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স রুল’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সত্যিকারের সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে ‘ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন’ বাস্তবায়ন করা।
৬. পথ দুর্ঘটনার তদন্ত ও সাজা ত্বরান্বিত করণের মধ্য দিয়ে সতর্কতা তৈরি করতে হবে এবং ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ সহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা-সহমর্মিতা-সচেতনতার পাশাপাশি সকল পথের চালক-শ্রমিক ও যাত্রীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
৭. স্পিড গান, সিসিটিভি ক্যামেরা, ইউলুপ বৃদ্ধি, পথ-সেতু সহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ে দূর্নীতি প্রতিরোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণি পর্যন্ত ‘পথ চলার নিয়ম-কানুন’ শীর্ষক বিশেষ শিক্ষা পর্ব বইতে যুক্ত করতে হবে।
/এএস