‘৭ বছরের ছোট মেয়েটি কোথায় আছে, কেমন আছে-জানি না’
‘দুই মেয়ে ঢাকাতে মায়ের কাছে। ৭ বছরের ছোট মেয়েটি কোথায় আছে, কেমন আছে? বেঁচে আছে কি না তাও জানি না। এখন আমি কী করব?’-কথাগুলো বলছিলেন জাপান থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশে ফেরা বাবা ইমরান শরিফ।
মঙ্গলবার (৩১ মে) রাজধানীর ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব) মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন ৩ মেয়ের বাবা ইমরান শরিফ।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের যৌথ নাগরিক ইমরান শরিফ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঢাকায় আমার দুই মেয়ের সঙ্গে আমি দেখা করতে পারছি না। আর আমার ৭ বছরের ছোট মেয়ে সোনিয়া শরিফের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলেও তার মা আমাকে কিছু বলছে না। আসলে সে আমাকে কিছু বলছে না, নাকি সে নিজেও কিছু জানে না তার ছোট মেয়েকে নিয়ে, তাও বুঝতে পারছি না।’
ইমরান শরিফ আরও বলেন, ‘আমি শুধু আমার ছোট মেয়েটিকে একবার দেখতে চাই। তার কথা শুনতে চাই। সে কেমন আছে জানতে চাই। একজন বাবা হিসেবে আমার চাওয়াটা নিশ্চয়ই বেশি কিছু নয়। আমার ছোট মেয়েটি নিরাপদে আছে, ভালো আছে, সুস্থ আছে-এই কথাটুকু আমি জানতে চাই। কিন্তু আমাকে কিছুই বলা হচ্ছে না, জানানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা চাইছেন আমি জাপানে যাই। কিন্তু জাপানের পারিবারিক আইনের ৮৬১ ধারা এবং জিম্মি বিচার ব্যবস্থার কারণে সেটিও সম্ভব নয়।’
এ সময় জাপানের পারিবারিক আইনের ৮৬১ ধারা এবং জিম্মি বিচার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে রয়টার্স ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে ইমরান শরিফ বলেন, আমার ছোট মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে আমি জাপানে গেলে দেশটির পারিবারিক আইন অনুসারে সেটি সম্ভব নয়। তার থেকে বড় সম্ভাবনা রয়েছে আমাকে জিম্মি বিচার ব্যবস্থার আওতায় সাব জেলে আটকে রেখে জবানবন্দি আদায় করার চেষ্টা হবে। যেখানে এই সাব জেলে আমি তাদের চাওয়া মত জবানবন্দি না দেওয়া পর্যন্ত প্রায় চার বছর বা তার বেশি সময় আমাকে সাব জেলে আটকে রাখার অধিকার রাখে দেশটির পুলিশ।
নিজের ৭ বছরের শিশুর সঙ্গে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা নেই জানিয়ে ইমরান শরিফ বলেন, তাদের মা ঢাকায় রয়েছে বিগত ৪ মাসের বেশি সময় ধরে। মা-বাবা, বড় দুই বোনকে ছাড়া আমার সন্তানটি কীভাবে আছে? তার কতটা কষ্ট হচ্ছে এটা বাবা হিসেবে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
জাপানে বিদেশিদের সন্তানকে ‘হাফু’ বলে সম্বোধন করা হয়। ‘হাফু’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘অর্ধেক’। সেখানে বিদেশি বাবা অথবা মা হলে তাদের সন্তানদের সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয় বলে জানান ইমরান শরিফ। আর এ কারণেই বাবা-মা ও বোনদের ছাড়া তার ছোট সন্তানটিকে নিয়ে শঙ্কিত তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হন বিট্রিশ আইনজীবী অ্যাডাম পেরি। তিনি জাপানে তার সন্তানকে হারিয়ে ফেলার বিষয়টি তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনে। অ্যাডাম পেরি বলেন, আমার স্ত্রী জাপানের নাগরিক ছিলেন, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর আমাদের পাঁচ বছরের মেয়েকে আমি হারিয়েছি। আমার সন্তানের বয়স যখন এগারো বছর, ঠিক তখন স্কাইপে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেই মেয়ে ‘ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করে। একজন বাবা হয়ে সন্তানের মুখে এমন কথা শোনা খুবই কষ্টকর।
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হওয়ায়, সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তার দেশে চলে যাওয়ার কারণেই এমমনটি ঘটেছে। ইমরান শরিফের স্ত্রীও যদি তার সন্তানদের নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে নিজের দেশে চলে যায়, তার জীবনেও আমার মতই ঘটনা ঘটতে পারে।
ইমরান শরিফ বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই আমার সকল সন্তানদের হারাতে চাই না। একজন বাবা হিসেবে কোনোভাবেই সন্তানদের ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারির খোলা আদালতের রায় ও ১২ এপ্রিলের লিখিত রায়ের পর থেকে পারিবারিক আদালতে করা মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগ বড় দুই মেয়েকে মায়ের কাছে রাখার আদেশ দেন। এরপর থেকে এই দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছিলেন ইমরান শরিফ। বর্তমানে তার বড় দুই মেয়ে ঢাকায় মায়ের কাছে রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছর ২১ নভেম্বর বাংলাদেশে হাইকোর্ট তার দুই সন্তানকে ইমরান শরীফের কাছে রাখার আদেশ প্রদান করেন। তবে শর্তে বলা হয়, প্রতিবছর তিনবার এবং প্রতিবার দশদিন বাংলাদেশে এরিকোকে সন্তানদের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে দেওয়া হবে। সন্তানদের মায়ের বছরে তিনবার বাংলাদেশে যাওয়া আসা ও দশদিন থাকার খরচ ইত্যাদি শরীফ ইমরানকে বহনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্য খরচ জাপানি নারী নিজেই বহন করবেন মর্মে রায়ে বলা হয়। মাসে দুইবার সন্তানদের সঙ্গে ভিডিওকলে মাকে কথা বলিয়ে দিতে হবে মর্মেও রায়ে বলা হয়।
কেএম/এমএমএ/