পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের খেলার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন: আইপিডি
পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের খেলার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। সোমবার (২৫ এপ্রিল) আইপিডি’র এক বিবৃতিতে একথা জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার কলাবাগানের উত্তর ধানমন্ডি এলাকার তেঁতুলতলা মাঠ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে আইপিডি। তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী রত্না হোসেন ও তার ছেলেকে পুলিশের আটক ও পরবর্তীতে মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়ার ঘটনাসমূহ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়।
এই মাঠ রক্ষার জন্য এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলনকে আন্তরিকভাবে আমলে নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে সমাধানের আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে এই অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানো যেত বলে বিশ্বাস করে আইপিডি। পাশাপাশি তেঁতুলতলা মাঠে থানা না করে অন্য কোন বিকল্প জায়গা খূঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবানকে স্বাগত জানাচ্ছে আইপিডি।
বিবৃতিতে বলা হয়, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধূলার গুরুত্বের কথা আমরা সবসময়ই বলে থাকি। রাজধানী ঢাকা শহরে দিন দিন শিশু-কিশোরদের বিনোদন এবং খেলাধুলার স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। যে কয়েকটি হাতেগোনা খেলার মাঠ অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর অধিকাংশই দখল কিংবা নানাবিধ কারণে খেলার মাঠ হিসেবে আর ব্যবহার করবার সুযোগ নেই। কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটি কলাবাগানের শিশু খেলাধূলা করার অন্যতম স্থান, অনেকের জন্যই একমাত্র স্থানও বটে।
আদর্শগতভাবে নগর পরিকল্পনায় ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা খেলার মাঠ তৈরি করতে হয় যার আয়তন ন্যূনতম এক একর (তিন বিঘা) হওয়ার কথা এমনটা উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি পাড়া-মহল্লায় প্রতি সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ থাকা উচিত যার মোট আয়তন হওয়ার কথা তিন একর।
অতি ঘন এলাকা কলাবাগানে আনুমানিক ৩০ হাজারের মত মানুষ বসবাস করেন। প্রতি ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি খেলার মাঠ দেয়া হলেও এই এলাকায় ৬টি খেলার মাঠ থাকার কথা, আকার-আয়তনে যা ৬ থেকে ১০ একর হওয়ার কথা। তেঁতুলতলা মাঠের আয়তন এক বিঘার মত, ফলে এই স্থানটিও পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের খেলবার মত পর্যাপ্ত নয়।
এই খেলার মাঠ রক্ষার আন্দোলন নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান রাষ্ট্রের জন্য যেমন কল্যাণকর নয়, তেমনি কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও রাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
একইসঙ্গে আইপিডি মনে করে, নগর এলাকাসমূহ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও নগরসমূহ বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মৌলিক দিকসমূহে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয়-পার্ক-খেলার মাঠ-থানা প্রভৃতি মৌলিক নাগরিক সেবাসমূহের জন্য ভূমি নির্ধারণ ও সংরক্ষণ ব্যতিরেকে নগর এলাকায় যত্র তত্র বাড়িঘর নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বাড়তে দিয়ে বিশাল সংখ্যক জনমানুষ বসবাসের ক্ষেত্রে এক চরমতর সংকটে পতিত হচ্ছে; পাশাপাশি রাষ্ট্র ও মৌলিক নাগরিক সুবিধা সংস্থান করতে গিয়ে নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
এই ধরনের অতি ঘন এলাকাতে বসবাসকারী শিশু-কিশোর-বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষের হাঁটার জায়গা, খেলার জায়গা ও বিনোদনের জায়গার অভাবে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যহানি ও অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। ফলে এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ-পার্ক-বিদ্যালয়সহ প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধাসমূহ তৈরি করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখনই দরকার।
আধুনিক নগর পরিকল্পনায় খেলার মাঠ-পার্ক-উদ্যানকে স্বাস্থ্য অবকাঠামো বিবেচনা করা হয়, পাশাপাশি এই ধরনের নাগরিক সুবিধা সমাজে অপরাধের প্রবণতাও কমায় বহুলাংশে। ফলে এই ধরনের মাঠকে কেন্দ্র করে যে ধরনের সামাজিক যোগাযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে উঠে তার ফলে খেলার মাঠকে শৃংখলা ও নিরাপত্তা অবকাঠামো হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সকলেই জানি, আমাদের নগর এলাকায় সুস্থ বিনোদনের অভাবে শিশু-কিশোরদের অনেকেই মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাংসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। অনেকেই অবসাদগ্রস্ত ও বিষণ্ন হয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র থানা বা জেলখানা নির্মাণের মাধ্যমে এই ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে না।
আমাদের রাষ্ট্রের আন্তরিকভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, শিশু-কিশোরদের জন্য যদি আমরা উপযুক্ত পরিমাণ খেলার জায়গা না তৈরি করতে পারি, তবে খেলাধূলাবিহীন দৈহিক ও মানসিকভাবে দূর্বল, পঙ্গু, বিপর্যস্ত, পথহারা, দিকভ্রান্ত প্রজন্মের জন্য একটি এলাকায় একটি থানা কখনোই পর্যাপ্ত হবে না।
আইপিডি মনে করে, কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটি এলাকার শিশু-কিশোরদের খেলার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের করার মাধ্যমে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় খেলার মাঠ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে বর্তমানে মাঠের চারপাশে দেয়াল নির্মাণের উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।
পাশাপাশি এই এলাকায় বিকল্প ভূমি অনুসন্ধানের মাধ্যমে থানা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেয়া একান্তভাবে অত্যাবশ্যক। কোন অবস্থাতেই স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশকে এই মাঠটি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানো যাবে না, যা আমাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।
আইপিডি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে আমাদের সবার স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাড়ার খেলার মাঠগুলোকে প্রাণবন্ত ও শিশু-কিশোরদের পদচারণায় মুখর করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকার আন্তরিক হলে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল এলাকায় খেলার মাঠসহ সকল নাগরিক সুবিধার প্রয়োজনীয় সংস্থান করা সম্ভব।
আরইউ/এসএ/