নব আনন্দে জাগার আহ্বানে ছায়ানটের বৈশাখ আবাহন
রমনার বটমূলে শান্ত ছায়াসুনিবিড় পরিবেশ। বিরাজ করছে ভোরের মুগ্ধতা। তখনও সূর্যকিরণ এসে পৌঁছায়নি। কয়েক স্তরে বিন্যস্ত বিশাল অনুষ্ঠান মঞ্চ। শুভ্র আর সবুজ পোশাক পরিহিত নানা বয়সি ৯০জন শিল্পী প্রস্তুত। ঘড়ির কাটায় ঠিক সোয়া ৬টা। রাগ সংগীতের সুরের মূর্ছনায় শুরু হলো ছায়ানটের বৈশাখ আবাহন। বাংলা নবষর্ষ ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে বরণ অনুষ্ঠান।
দুই বছর পর প্রাণ ফিরল রমনার বটমূলে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ অনুষ্ঠান গত দুই বছর অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৬৭ সালে (১৩৭৪ বঙ্গাব্দে) পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার আবহে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠান দেশের বাংলা বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর আগে কেবল একবার এ অনুষ্ঠান হতে পারেনি। সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে, বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের কালে। ২০০৪ সালে এ অনুষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি হামলার পর দেশের মানুষ আরও বেশি আপন করে নিয়েছে এ অনুষ্ঠানকে।
১৪২৯ বঙ্গাব্দকে বরণ করতে রমনার বটমূলে প্রাণের উচ্ছ্বাসে যোগ দেয় হাজার-হাজার মানুষ। রমনাপার্কের প্রতিটি প্রবেশমুখে কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশির পর ঢুকতে দেওয়া হয় দর্শনার্থীদের। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ বিশিষ্টজনরাও যোগ দেন।
শুরুতেই আলাপ ‘রাগ রামকেলী’ পরিবেশন করে সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দেন শ্রাবন্তী ধর। এর পরপর পরিবেশন করা হয় রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রয়ী গান ‘মন, জাগা মঙ্গললোকে’, সেতারে আলাপ ‘রাগ অহীর ভৈরব’, নজরুলের রাগাশ্রয়ী ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ ও আলাপ ‘রাগ টোড়ি’।
‘জাগো জাগো খোলো গো আঁখি’ সুস্মিতা দেবনাথ শুচির কণ্ঠে এ নজরুলসংগীত দিয়ে শুরু হয় ছায়ানটের কণ্ঠ শিল্পীদের পরিবেশনা। কখনো একক, কখনো সম্মিলিত গানে সোয়া দুই ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন শিল্পীরা। এ ছাড়াও ছিল ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় ও ডালিয়া আহমেদের আবৃত্তি।
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত ‘এ কী সুগন্ধহিল্লোল বহিল’ সত্যম কুমার দেবনাথ, ‘গাও বীণা, বীণা গাও রে’ লাইসা আহমেদ লিসা, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’ অভয়া দত্ত, ‘কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে’ তাহমিদ ওয়াসিফ ঋভু, ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে’ তানিয়া মান্নান, ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’ এ টি এম জাহাঙ্গীর গেয়ে শোনান।
নজরুলসংগীত ‘আনো আনো অমৃত বারি’ খায়রুল আনাম শাকিল, ‘জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে’ মাকসুদুর রহমান খান মোহিত, ‘অন্তরে তুমি আছ চিরদিন’ শাহীন সামাদ, ‘আজ সকালে সূর্য ওঠা সফল হল মম’ কানিজ হুসনা আহম্মদী গেয়ে শোনান।
রজনীকান্ত সেনের ‘এত আলো বিশ্বমাঝে’ পরিবেশন করেন সুতপা সাহা। অতুলপ্রসাদ সেনের ‘আপন কাজে অচল হলে’ সেমন্তী মঞ্জুরী ও ‘যদি তোর হৃদযমুনা’ শারমিন সাথী ইসলাম গেয়ে শোনান।
সুমন মজুমদার গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আজি গাও মহাগীত’। লালন সাঁই-এর ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’ গাইলেন বিমান চন্দ্র বিশ্বাস।
একঝাঁক শিল্পীর সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় নজরুলসংগীত ‘প্রভাত বীণা তব বাজে হে’, ‘ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কাহারা যেন ডাকে’ ও ‘নবীন আশা জাগল যে রে আজ’, রবীন্দ্রসংগীত ‘নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ ও ‘পারবি না কি যোগ দিতে’, গুরু সদয় দত্তের ‘বাংলাভূমির প্রেমে আমার’ এবং গিরীন চক্রবর্তীর ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’ গানগুলো।
এবারে আসরের বড় চমক ছিল অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছায়ানট সভাপতি সংগীতজ্ঞ সনজীদা খাতুনের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘নব আনন্দে জাগো’ পরিবেশনা। এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে এই গানের বাণীকে ধারণ করা হয়। প্রতিবারের আয়োজনে তিনি মূল কথন প্রদান করলেও এবার তিনি গান গাইলেন। আর ছায়ানটের কথন পাঠ করলেন মুক্তিযোদ্ধা-সংগঠক ডা. সারওয়ার আলী। কথনে তিনি হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে মানবিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানান। আহবান জানান দুঃসময় পেরিয়ে নব আনন্দে জাগ্রত হওয়ার।
সবশেষে শিল্পী-দর্শক-শ্রোতা সবাই একসঙ্গে জাতীয়সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সুর ও বাণীও সোয়া দুই ঘণ্টার মিলনমেলা।
ছায়ানটের বৈশাখ কথন:
নব আনন্দে জাগো
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উৎসব, নতুন বর্ষবরণ। এই প্রভাতে, সকলে নবজীবনের অঙ্গীকারে নতুন করে আবদ্ধ হোক। বৈশাখ এসেছে, সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
“বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্ অতলের বাণী
এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
এল গভীর ছায়া ফেলে৷
রুদ্রতপের সিদ্ধি এ কি ওই-যে তোমার বক্ষে দেখি,
ওরই লাগি আসন পাতো হোমহুতাশন জ্বেলে৷
নিঠুর, তুমি তাকিয়েছিলে মৃত্যুক্ষুধার মতো
তোমার রক্তনয়ন মেলে।
ভীষণ, তোমার প্রলয়সাধন প্রাণের বাঁধন যত
যেন হানবে অবহেলে।
হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে,
দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে৷”
হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে মানবিক সমাজ গঠনে আমাদের প্রাণিত করে বাংলা নববর্ষ। এই প্রত্যয় অর্জনে অর্ধশতাধিক বছর ধরে সুর ও বাণীর আবহে রমনার বটমূলে আয়োজিত হচ্ছে বাঙালির মিলনমেলা। অতিমারির কারণে গত দুটিবছর আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় এবং স্বজনহারানোর বেদনা নিয়ে আমরা গৃহবন্দি ছিলাম। দুঃসময় পেরিয়ে এবার নব আনন্দে জাগ্রত হওয়ার আয়োজন।
‘নব আনন্দে জাগো আজি রবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে।
নব আনন্দে জাগো ....”
সকল লোভ- বিদ্বেষ- অসহিষ্ণুতা কাটিয়ে সকলের জীবনে নুতন বছর মঙ্গল বার্তা বয়ে আনুক, দেশের উন্নয়নে গতি সঞ্চার করুক।
শুভ নববর্ষ
এপি/টিটি/