জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করে উজ্জীবিত বাঙালি
আজ ১৪ ডিসেম্বর ২০২১। ঠিক ৫০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসর আল-বদর, আল-শামসরা। সেদিন বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
প্রতিবছর এই দিনটি আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেনতনায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবি সংগঠণ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শহিদ পরিবারের সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে।
মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) সকাল ৭ টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রাষ্ট্র প্রধানের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালেহ উদ্দিন ইসলাম তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে সীমিত পরিসরে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী দেশের মহান বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
৫০ বছর আগে এই দিনে দেশের ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর চোখ বেঁধে নিজ নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয় অধ্যাপক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, প্রকৌশলী ও লেখকসহ মাটির দুই শতাধিক কৃতী সন্তানকে। প্রথমে তাদের চোখ বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরবর্তীকালে, নতুন উদীয়মান বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করার জন্য তাদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে, বিশেষ করে রায়েরবাজার ও মিরপুরে হত্যা করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যারা খুনিদের রোষানলে পড়েন তাদের মধ্যে ছিলেন ডা. আলিম চৌধুরী এবং ডা. ফজলে রাব্বি, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান, সেলিনা পারভীন এবং সাহিত্যিক মুনীর চৌধুরীসহ আরও অনেকে। এরপর থেকে দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। একে একে সকল রাজনৈতিক দল পেশাজীবী সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান ও কেন্দ্রিয় নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ ছাড়া শ্রদ্ধা জানায় বিএনপি, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম (কামাল হোসেন অংশ), গণফোরাম (মন্টু-সুব্রত), গণসংহতি আন্দোলন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ ছাড়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু ও সাধারণ সম্পাদক ডা. নূরুল ইসলাম হাসিবের নেতৃত্বে ডিআরইউ সদস্যরা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধু কৃষিজীবী পরিষদ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ছাড়াও রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অনেকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করার পাশাপাশি তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকলেই এক সুরে কথা বলেন। অনেকে বলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানোর পর দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন,
‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক সেই সময় বাঙালির মেধা ও বিবেক হিসেবে খ্যাত বুদ্ধিজীবীদের জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে হত্যা করেছিল। সেদিন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, বাঙালির কাছে। তাদের আন্তর্জাতিক যে প্রভু রয়েছে তারাও সেদিন পরাজিত হয়েছিল। আজকেও যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে এই বাঙালি জাতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে। এই হল বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রত্যয়।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা। সব বুদ্ধিজীবীদের চেতনাকে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলক হক বলেন, ‘পালিয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের ফিরিয়ে আনতে সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আশ্রয়দাতা দেশগুলো তাদের দেশের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কথা বলে তাদের হস্তান্তর করছে না।’
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা আন্তর্জাতিক চক্রকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তির এই সময়েও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধে জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। যে উদ্দেশে বুদ্ধিজীবীরা আত্মদান করেছেন, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা এ বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূরণ করতে চলেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ১৯৭১ সালে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম, আমাদের অগণিত সৈনিক প্রাণ দিয়েছেন, বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়েছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি।’
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, যে উদ্দেশে বীর শহীদরা জীবন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের রাজনীতি চলবে। আমরা বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে এগিয়ে যাব। আমরা তেমন বাংলাদেশ গড়তে চাই যেমন বাংলাদেশ গড়তে বীর শহীদরা জীবন উৎসর্গ করেছেন।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘স্বাধীন ছিল মাত্র ২৪ দিন। ১৯৭১ সালে ৯ জানুয়ারির পর পাকিস্তানি শাসন ব্যবস্থা আবার জারি হয়ে গেছে। ৫০ বছরের অর্জন হলো, গণতন্ত্রের সম্মেলনে আমরা যেতে পারিনি। এটাই হলো অর্জন। সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। এরপর গত ৫০ বছরে অর্জন কী, আর ভোট চুরি কী; কোনোটিরই মূল্যায়ন হয়নি।’
রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস স্বাধীনতার বিপক্ষশক্তি রাজাকার, আল বদর, আল শামসসহ যুদ্ধাপরাধে জড়িত সকলের পূর্ণাঙ্গ বিচারের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি, বিভিন্ন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং তারা এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকলেই স্লোগান দিতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হবে। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
এসএম/এমএমএ/