পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ব্রিটিশ আমলের অস্ত্র-সরঞ্জাম
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারক নিয়েই 'বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।'
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম ভবনে প্রথম জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। আর এখনকার ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত। রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গোলাবর্ষণ শুরু করে পুলিশ লাইন্সকে ঘিরে। ভিতরে তখন আটকা বাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার পুরোনো বন্দুক বা থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষী কনস্টেবল আব্দুল আলীর পাগলা ঘণ্টা ধ্বনিতে যা ছিল তা নিয়েই গর্জে উঠলেন বীর পুলিশ সদস্যরা। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপক্ষে প্রাণপণ লড়াই চললো কয়েক ঘণ্টা। সেই রাতে শহীদ হলেন কমপক্ষে দেড়শ বাঙালি পুলিশ সদস্য।
এ জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে। দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার।
এছাড়া ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম স্থান পেয়েছে এখানে।
দর্শনার্থীরা ১০ টাকার টিকেটের বিনিময়ে জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে পারেন। গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। তবে ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং সব জাতীয় দিবসে সবার জন্য বিনামূল্যে জাদুঘর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। সাপ্তাহিক বন্ধ বুধবার ছাড়া শুক্রবারও বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নসহ দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের বীরত্বের স্মৃতিগাথা তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ জাদুঘরে আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের নানান স্মারক।
২০০৯ সালে তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদ (বর্তমানে এমপি) ও ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার একেএম শহীদুল হকের (সাবেক আইজিপি) সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশের তৎকালীন ডিসি মো. হাবিবুর রহমান (বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি) জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন করে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগও নেন মো. হাবিবুর রহমান।
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের টেলিকম ভবনে দুটি রুম নিয়ে প্রথম পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। জাদুঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশাল সংগ্রহশালা। যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুলিশ বাহিনীর নানান স্মৃতিচিহ্ন, অস্ত্র, পোশাক, দলিল-দস্তাবেজ। এমনকি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহার করা রিভলবারটিও সংরক্ষিত আছে এ জাদুঘরে।
দর্শনার্থীরা গেলেই জাদুঘরে দেখতে পাবেন- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, যুদ্ধের সময় উদ্ধার করা গুলি ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হ্যান্ডমাইক, যুদ্ধের সময় দূর থেকে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য পুলিশ বাহিনীর সার্চ লাইট, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চিঠিপত্র, ২৫ মার্চ রাতে সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হেলিকপ্টার ব্যাজ, বেতার যন্ত্র, ওয়্যারলেস সেট, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেঞ্চ ও প্রথম প্রতিরোধের রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা পাগলা ঘণ্টাসহ শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এ জাদুঘরে আরও আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা ৭.৬২ এমএম রাইফেল, রিভলবার, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং মর্টারশেল, ৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম, এলএমজি .৩২ বোর রিভলবার, .৩৮ বোর রিভলবার, ১২ বোর শর্টগান ও ৯ এমএম এমএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সমাহার।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ১ জন ডিআইজি, ৪ জন পুলিশ সুপার, ১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ১ জন ডিএসপি, ১ জন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহীদ হন।
এদের মধ্যে রয়েছেন- তৎকালীন রাজশাহীর ডিআইজি মামুন মাহমুদ, রাজশাহীর পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ, কুমিল্লার পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, পিরোজপুর মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) এবং কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ডক্টর জাফর ইকবালের বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদসহ অনেকে।
পুলিশের ৫ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন বীরবিক্রম ও ২ জন বীর প্রতীক।
কেএম/কেএফ/