নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পরামর্শ বিশিষ্টজনদের
নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। পাশাপাশি দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তারা। কঠিন এই কাজে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে দ্বিতীয় ধাপের এ সংলাপে বিভিন্ন পেশার ১৯ জন অংশ নেন। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংলাপে অনেকে ইভিএম ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন। সবার মতামত পর্যালোচনা করে অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের আশ্বাস দেন নতুন সিইসি।
আলোচকরা বলেছেন, ‘ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি ভোটারদের আস্থা ফেরাতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে উদ্যোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে কমিশনকে কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে তারা নিরপেক্ষভাবে ভোট করবেন।
নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরানো, ইভিএমে ব্যবহার না করা, দলীয় সরকারের সময় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করা, নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করতে না দেওয়া এবং প্রতিবন্ধতা হলে বর্তমান কমিশনকে প্রয়োজনে পদত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সাহসী হতে তাগিদ দেন তারা।
ইভিএমের বিরোধিতা করে যা বললেন বিশিষ্টজনেরা
সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দুরে থাকা ভালো। ইভিএম নিয়ে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। ইভিএম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা উচিত নয়।
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। একটি ভালো ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন দেবেন।’
এ বিষয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না-তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলব- ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইভিএম এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে, তবে এটা না হওয়াই ভালো।’
তিনি জানান, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সংকটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এ ছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নিরপেক্ষ থেকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনদের সবাই। আস্থা ফেরাতে কাজ দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করার পরামর্শ দেন তারা।
দেবপ্রিয় বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনার উপর আস্থা ফিরিয়ে আনারই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কিনা তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।’
লিডারশিপ স্ট্রাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ, বলেন, ‘ইসি এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সংকট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’
তিনি জানান, ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দুটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দ্বিতীয় দিনের সংলাপে যারা অংশ নিয়েছেন
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বেগম শাহীন আনাম, নিজেরা করি’র কো-অর্ডিনেটর খুশী কবির, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দীন আহমেদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মোস্তাফিজুর রহমান ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম,, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, লিডারশিপ স্ট্রাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, বাংলাদেশ ইনডিজিনিয়াস পিপলস ফোরাম সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও ঢাবি আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন, গভর্নেন্স এ্যান্ড রাইট সেন্টারের প্রেসিডেন্ট জহুরুল আলম, ঢাকি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা।
শুরু থেকেই অংশগ্রহণমূলক ভোট আয়োজনে রাজনৈতিক সমঝোতার তাগিদ দিয়ে আসছেন নতুন সিইসি।
দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের মতামত নেয় নতুন কমিশন, ২২ মার্চ বসেন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে। মাসের শেষে গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সঙ্গে বসার কথা রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন ইসি গঠনের পর ধারাবাহিক সংলাপ চলছে। দুই দফায় শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবিদের সঙ্গে বসলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন।
এসএম/এমএমএ/