ক্রান্তিকালের ত্রাতা ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ
দেশের গভীর সংকটকালে রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্ব নিয়ে দেশকে একটি নতুন যুগে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশায় ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংকটকালে সাহাবুদ্দীন আহমদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো।
ক্রান্তিকালের ত্রাতা হিসেবে এবং দীর্ঘ স্বৈরশাসন পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
১৯৯০ সালের নভেম্বর মাস থেকে স্বৈরাচার হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তুঙ্গে উঠে। ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম মহাসচিব এবং জাসদ নেতা ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কাছে এরশাদের পেটোয়া বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পরপরই স্বৈরাচার এরশাদের পতনের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরই এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এরশাদের এই ঘোষণার পরপরই শুরু হয় একজন দল নিরপেক্ষ এবং সব মহলে কাছে গ্রহণযোগ্য এমন এক ব্যক্তির অনুসন্ধান। এরশাদ কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এই নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল এবং দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলির মোর্চা ৫ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দলনিরপেক্ষ এবং সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে খোঁজা শুরু হয়।
৮ ও ৭ দলীয় জোট নিজেদের দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ ব্যক্তির সন্ধান দিতে পারছিল না। তখন বাম মোর্চার পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদের নাম প্রস্তাব করা হয়।
সাহাবুদ্দীন আহমদে নাম আসার সঙ্গে সঙ্গেই ৩জোট কোনরকম বিতর্ক ছাড়াই সব মহলেই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেয়। এরপর স্বৈরশাসক এরশাদ তার উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দেয। ৫ ডিসেম্বর মওদুদ আহমদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তিন জোটের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শর্ত ছিল, দেশবাসীর কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি আবার স্বপদে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাবেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে সকল রাজনৈতিক দল ও মানুষের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেন বিচারপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকার। এরপর রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি তার পূর্ব শর্ত অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যান।
সাহাবুদ্দীন ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। ছিলেন নির্লোভ। ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। নিজের কাজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল এবং যত্নবান। তার এই ব্যক্তিত্ব, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ থাকা এসব কারণেই তিনি ছিলেন সবার পছন্দের এবং গ্রহণযোগ্য মানুষ। দেশবাসীর কাছে একজন সৎ, নির্লোভ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে আজও মর্যাদার আসনে আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ।
এনএইচবি/কেএফ/