সাভার ট্যানারি নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের টানাটানি
সাভার ট্যানারি শিল্প নিয়ে একটা প্রবাদ বাক্যের কথা মনে পড়ে গেল ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’। দূষণের হাত থেকে ‘বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে যেয়ে ধলেশ্বরীকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার’।
এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। খোদ পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে পরিবেশন দূষণের কথা। তাই আপতত সাভার ট্যানারি শিল্প বন্ধ রাখার পক্ষে তারা। তবে কে শোনে কার কথা আদালতের নির্দেশনা ও সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কোনাটাই আমলে নিচ্ছে না শিল্প মন্ত্রণালয়। দূষণ হচ্ছে জেনেও চালু সাভার ট্যানারি। এটা দুঃখজনক বলে মনে করেন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।
সাভারের চামড়া শিল্প নগরী কমপ্লায়েন্স অর্জন না করা পর্যন্ত বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি কতদূর জানতে চেয়েছিল সংসদীয় কমিটি। তাদের সুপারিশের আলোকে একটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির নিকট দেয় মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনের কপি ঢাকাপ্রকাশের হাতে রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধনের দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে শুনানি গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এ ছাড়া সাভার ট্যানারি কমপ্লেক্স কেন বন্ধ করা হবে না, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কাছে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সচিব বরাবরও পত্র প্রেরণ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক ট্যানারি কমপ্লেক্স পরিদর্শন ও মতবিনিময় এবং হাইকোর্টের আদেশের আলোকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গৃহীত সুপারিশসমূহ প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে বলে কমিটিতে জানানো হয়।
এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অর্জন না করা পর্যন্ত শিল্পনগরী বন্ধ রাখার কথা ছিল, কিন্তু বন্ধ করা হয়নি।
জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স অর্জনের পথে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সচিব এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন তাদেরকে (বিসিক) চাপে রাখা হচ্ছে। ছাড়পত্র প্রাপ্ত ট্যানারিগুলোকে পুনরায় নবায়ন প্রদান বন্ধ রয়েছে এবং নতুন করে কোনো ট্যানারিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা হয়নি।’
এ বিষয়ে কমিটিতে পরিবেশন বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দীন বলেন, ‘এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা হয়েছে, তারা হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে। যেহেতু অন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাই একেবারে বন্ধ করা বিব্রতকর হচ্ছে।
এর জবাবে কমিটির সভাপতি বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা মতই কমপ্লায়েন্সের কথা বলা হয়েছে এবং শিল্প মন্ত্রণালয় অস্বীকার করেছে তারা বর্তমানে নন-কমপ্লায়েন্স। সুতরাং হাইকোর্টের নির্দেশনা ও সংসদীয় কমিটির সুপারিশ যেটির সঙ্গে মন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী সকলে সকলে একমত। তারপরও বাস্তবায়ন না করার কোনো অজুহাত বা কারণ হতে পারে না।’
পরে মন্ত্রী সংসদীয় কমিটিকে আশ্বস্ত করেন যে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রীর
সঙ্গে আলোচনা করে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবেন। মন্ত্রীর এই কথায় সভাপতির অসন্তোষ। সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এতদিন পরেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি, যা দুঃখজনক।’
চামড়া শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত পরিবেশে উন্নীত করতে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় বিসিক। হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের অনীহা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের এপ্রিলে আদালতের নির্দেশে তাদেরকে সেখানে যেতে বাধ্য হতে হয়।
শুরুতে কথা ছিল শিল্পনগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ট্যানারিগুলো নিজেরাই ইটিপি স্থাপন করবে। কিন্তু ট্যানারিগুলো তা না করায় শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্পের আওতায় সিইটিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১০ সালে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। তখন প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৫৪৫ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে শিল্পনগরীর কোনো সুবিধা নিশ্চিত না করে ট্যানারিগুলোকে বারবার স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দিতে থাকে শিল্প মন্ত্রণালয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় উচ্চ আদালত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে কারখানাগুলো একযাগে স্থানান্তরিত হয়। সিইটিপির বিভিন্ন কম্পোনেন্টের কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ১৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন শুরু করে। ফলে আগে হাজারীবাগে বর্জ্য ও দূষিত তরল বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে মিশত, তা এখন সাভারে ধলেশ্বরী নদীতে মিশছে।
গত বছরের ২৩ অগাস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় সাভারের চামড়া শিল্প নগরী ‘আপাতত বন্ধ রাখার’ সুপারিশ করা হয়।
এসএম/এমএমএ/