নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার দাবি
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করাই অন্যতম অঙ্গীকার বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
তিনি বলেন, ‘শুধু নারী বা পুরুষ নয় সকলকে সঙ্গে নিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারী এবং পুরুষের কোন বিভাজন থাকবে না, নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সমতা থাকতে হবে। পুরুষই নারীর অভিভাবক হবে এই সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে না। এগুলো করতে হলে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে। সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাধাগুলো আছে, সেই বাধাগুলো দূর করতে হবে।’
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি আয়োজিত সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করো সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করো এই ঘোষণাপত্রকে ধারণ করে ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম দিবসটি উদযাপন করে। সমাবেশ শেষে একটি র্যালি
বের করা হয়।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন এক নারী সমাজকে গড়ে তুলেছি। যে নারী সমাজ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নিজের কাজের কথা বলতে শিখেছেন। বাংলাদেশের নারী সমাজ এদেশের নারীর ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করবেই। সেই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্রের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যে অসম্প্রদায়িকতার কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যে দেশপ্রেমের অঙ্গিকার আছে সেই সব নিয়ে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন এগিয়ে যাবে। যে কোনো দেশের নারী আন্দোলনের মতো বাংলাদেশের নারী আন্দোলনও বিকশিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি পদে পদে।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ, আর আমাদের স্বাধীনতার মাস এক সঙ্গে। আমাদের আন্দোলন আর স্বাধীনতার আন্দোলন যুগপৎ সন্ধি। এই যুগপৎ আন্দোলনের জাতীয় বিকাশের মধ্য দিয়ে নারীর বিকাশ হবে। জাতীয় বিকাশের ক্ষেত্রে যা যা সংকট আছে সেই সংকটগুলো আমাদেরও সংকট; যেমন গণতান্ত্রিক সংকট, সাম্প্রদায়িকতার সংকট, উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আঘাতের সংকট, সেই বিষয়টি যেমন আছে তার সঙ্গে আমাদের নারী জীবনের সমস্যা আছে। আমরা যখন বলছি নারী পুরুষের সমতা না হলে টেকসই উন্নয়ন হবে না, তখন সমগ্র জাতিকেই এই নারী পুরুষের সমতার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। সমগ্র জাতিকে দাঁড় করানো এটা হচ্ছে আমাদের নারী আন্দোলনের অন্যতম কাজ।’
তিনি আরও বলেন, শুধু নারী নয় বা শুধু পুরুষ নয়, কাউকে বাদ দিয়ে নয়; নারী পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ সকলকে সঙ্গে নিয়ে এই সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে গড়ে তুলতে হবে। সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে বাধাগুলো আছে যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বাধা। নারী পুরুষের সম্পর্ক, নারী পুরুষের শ্রম বিভাজন এগুলোর ক্ষেত্রে যে বাধা। নারী শ্রম এবং পুরুষের শ্রমকে আলাদা করে দেখা হয়। গৃহ শ্রম নারীর জন্য বাইরের শ্রম পুরুষের জন্য আমরা মনে করি শ্রমে কোনো বাধা থাকতে পারে না। নারী এবং পুরুষের কোনো বিভাজন থাকবে না। নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সমতা থাকতে হবে।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আজকের দিনের অঙ্গীকার নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করব। সেই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করব। যতই নারী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে কিন্তু সহিংসতা একেবারেই কমে আসছে না। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ নারীকে অধস্তন ভাবা, নারীকে মানুষ বলে মনে না করা এগুলো বন্ধ করতে হবে।
সমাবেশে সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০টি দাবি তুলে ধরা হয়। সরকার ও সমাজের কাছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়।
১.সংবিধানে প্রদত্ত সমঅধিকার বাস্তবায়নের জন্য আইনগত পদক্ষেপে নিতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে।
২.সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকান ও সম অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৩.নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়, প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোন বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষনিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৫. অপরাধীকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৬. মাদকের ব্যবসা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. ধর্ষণের মামলার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।
৮. উত্ত্যক্তকরণ ও যৌননিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোটর্ বিভাগের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৯. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১২ এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে অবমাননা করে যে সব প্রতিবেদন প্রকাশ/প্রচার করা হয় তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
১০. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া চলবেনা।
১২. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা,অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সময়কে বিবেচনায় নিয়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আরও জোরদার করতে হবে।
১৪. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে। (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়সমূহ।)
১৫.নারী গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং এ বিষয়টিকে শ্রম আইনে অর্ন্তভ’ক্ত করতে হবে।
১৬.গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
১৭.২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৮.ধর্ষণের শিকার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীর আইনগত সহায়তার ক্ষেত্রে ইশারা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
১৯.বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
২০.জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা ওয়াই ডাব্লিউসিএ এর উপাধ্যক্ষ ফ্লোরেন্স গোমেজের সঞ্চালনায় সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহেনা বেগম। এছাড়া সঙ্গীত পরিবেশন করেন নবনীতা চৌধুরী ও ছায়া কর্মকার, আবৃত্তি করেন পঞ্চকন্যা (শারমিন লাকি, তামান্না তিথি, নাজনীন নাজ, বুশরা তিথি ও হাবিবা হ্যাপী। নৃত্য পরিবেশন করেন অংকিতা সাহা।
এসএম/এমএমএ/