ধারাবাহিক গল্প: পর্ব- ৩
অস্ফুট ভালোবাসা
অনিন্দ্যের আজ ডে অফ। গতকাল ফারাহকে সেটা জানানো হয়নি। তাহলে একটু দেরিতে ফোন করত। ঘড়ির দিকে তাকায় অনিন্দ্য। ১১টা। এখনই বাবার ফোন আসবে। বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয় সপ্তাহের ছুটির দিন। কারণ আমি যখন বাড়ি ফিরি বাবা তখন ঘুমান। আবার তিনি যখন বাড়ি ফিরেন তখন আমি অফিসে। তাই চেষ্টা থাকা সত্বেও বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয় না। ভাবতে ভাবতে অনিন্দ্য বিছানায় উঠে বসতেই ফোনটা বাজল।
কলিং বেলের শব্দ শুনে ফারাহ এসে দরজা খুলল। যতটা অবাক হবে ভেবেছিলাম ততটা হয়নি। শুধু বলল একি সূর্য আজকে কোন দিক দিয়ে উঠেছে। আজ অফিস নেই আমাকে আগে বলোনি কেন?
-সারপ্রাইজ দেব বলে।
-ভালইতো। তো কি ব্যাপার হঠাৎ মনে এত ভালোবাসা জেগে উঠল যে।
-তোমার কি শরীর খারাপ না মন খারাপ?
-দুটোই ভাল আছে।
-তা হলে তোমার কথা এমন তেতো শুনাচ্ছে কেন?
-আমার কথা তোমার কাছে আজ তেতো শুনাবে, কাল শুনতে ইচ্ছে করবে না। পরে বলবে আর যোগাযোগ করোনা। এভাবেই তো। সম্পর্ক শেষ।
-ভালোই তো গল্পটা। তুমি লিখে রাখ না কেন? তোমার কথার এক একটা লাইন একদিন বিশাল উপন্যাস হয়ে যাবে।
-তাই নাকি। চলো ঘরে ভালো লাগছে না কোথাও বেড়িয়ে আসি।
-আমার ইচ্ছে ছিল। থাক তোমার বোধ হয় আজ মন ভালো নেই।
-বেশি বকবক করো না তো। চল।
আশুলিয়া পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পথে ফারাহ খুব চুপচপ ছিল। কারণটা অনিন্দ্য এখনও জানে না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আচ্ছা অনিন্দ্য এ জায়গাটারতো আহামরি কোন সৌন্দর্য নেই, তবু মানুষ জায়গাটকে এত সুন্দর বলে কেন বলোতো।
জানি না। হয়তো লেকটার জন্য। হয়তো মুক্ত পরিবেশটার জন্য। আমরা শহুরে মানুষগুলো তো সারাদিন ইট, পাথর, ধোঁয়া, গাড়ি আর মানুষ ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। রাতে আকাশ দেখা যায় তাও আবার শহরের চাকচিক্যের সঙ্গে উপভোগ্য নয়। ডোবা দেখলেই বলে উঠি কি সুন্দর লেক। আর ওই ডোবার মালিক মুচকি হাসে।
আসলে আমরা মানুষ আমাদের পৃথিবীটাকে অসুন্দর করে গড়ে তুলছি। এই যে দেখো একটু মুক্ত বাতাসের জন্য আমাদের কত দূর আসতে হয়েছে। অথচ শহরটা যদি পরিকল্পিত হতো তাহলে তোমাদের বাড়ির গেটের কাছে বসে প্রেম করতে পারতাম।
ফারাহ অনেকক্ষণ পর হাসিতে ফেটে পড়ল।
তবে এটাও ঠিক তখন আর সুন্দরের এত কদর থাকত না। তোমার মতো রোমিওরা বাড়ির গেটের সামনে বসে পড়ত। আর মা বাবার হাতে ধরা খেয়ে বিরহে দিন কাটাত। আসলে সুন্দরকে কখনই কোনো বৃত্তের মাঝে বন্দি করে রাখতে নেই। সুন্দর হবে দূর আকাশের মতো। যাতে মানুষ দূর থেকে একে উপলব্ধি করতে পারে।
দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে গেল। তবে পশ্চিম আকাশের লালিমা তখনো কাটেনি। পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। গল্প কবিতায় এমন ডায়লগ পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে এর উপলব্ধি আজকের মতো আগে আর কারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার পেশাটা আমার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ফেলে আসা ছাত্র জীবনে। যে সময়টায় ইচ্ছে করলেই কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়া যেত। বাঁধন হারা পাখিদের মতো ঘুরে বেড়ানো যায়। আজ বাবা আমার কাছে সময় চান। দিতে পারি না। ফারাহ চায় আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে কিন্তু পারি না। আমার যে একটা সুন্দর মন আছে ফারাহ অনেক সময় মানতেই চায় না। বলে তোমাদের সাংবাদিকদের আবার সুন্দর মন। সারা দিন যাদের কাজ অসুন্দরকে ঘিরে। বলে তোমরা সাংবাদিকরা প্রতিদিন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খারাপ সংবাদ ছাপাও। মনে হয় পৃথিবীতে কোনো ভালো খবর নেই। আমি বলি কি করব খারাপ ঘটনা ঘটে বলেইতো আমরা পত্রিকা বের করতে পারি আর পাঠক সেটা পয়সা দিয়ে কেনে।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আমরা অনেকক্ষণ নীরব সময় কাটিয়ে দিয়েছি। মনে হয় কেউ যেন কারো নীরবতাকে ভাঙতে চাচ্ছি না। তবে ফারাহর যে কিছু একটা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি। সে এতটা চুপচাপ থাকার মেয়ে না।
ফারাহ, সন্ধ্যা হয়ে গেছে উঠবে নাকি। ফারাহ কিছুটা চমকে উঠল।
-থাকি না আর কিছুক্ষণ। তোমার কি কোনো কাজ আছে।
-না আজকের দিনটা শুধু তোমার জন্য রেখেছি।
তাই নাকি। ফারাহ একটু মুচকি হাসল।
-আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলোতো?
-কই কিছু নাতো।
-তাহলে এমন মুখ ভার করে বসে আছ কেন?
-তুমি কি কোনো হাসির কথা বলেছ যে হাসব?
-তা না বললেও তোমার চেহারা দেখে বুঝা যায় তোমার কিছু একটা হয়েছে।
-না। কিছু হয়নি। তুমি যাবার আগে বাবার সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।
-কি নিয়ে জানতে পারি।
-ওই একই বিষয়। বিয়ে করছি না। আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করছি না। এইতো।
-উনার কথারতো যুক্তি আছে। চাকরিটা না হয় নাই করলে। তোমার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়েটা করে ফেলতে পার।
-ফারাহ একটু গম্ভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। কাকে বিয়ে করব?
-কেন তোমার যাকে মন চায় তাকেই করো। আমার সঙ্গে তোমার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে তাই বলে যে আমাকে বিয়ে করতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই।
-আমি কিন্তু বলিনি তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। অনিন্দ্য এখানেই তো সমস্যা। আমি কাকে বেছে নেব। যার সঙ্গে আমার মনের মিল হয় তাকে? নাকি কোনো অপরিচিত একজনকে। যাকে আমি চিনি না। জানি না।
-আচ্ছা অনিন্দ্য, আমাকে ঘিরে তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?
-আসলে এ বিষয়টি নিয়ে কখনো ভাবিনি। আসলে ফারাহ তুমি আমার প্র্যাকটিকেল লাইফে মিশে গেছো। তোমাকে জড়িয়ে কিংবা তোমাকে ছাড়া কোনো ভাবনা আমার মনে আসেনি। আজ থেকে না হয় ভাবব তোমাকে নিয়ে আসলেই আমার কোন স্বপ্ন আছে কি না?
গাড়িটা গেটে ঢুকতেই দেখি ফারাহর বাবা আশরাফ চৌধুরি দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারাহকে বললাম আমি চলে যাই। কিন্তু তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন ফারাহকে।
ফারাহর বাবার মুখোমুখি অনিন্দ্য এর আগেও বেশ কয়েক বারই হয়েছে। কিন্তু প্রথম প্রথম তিনি যে ভাবে আমাকে ডেকে নিত এখন তা করেন না। বিশেষ করে চট্টগ্রাম স্টেশনে তিনি আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে ছিলেন এখন সে দৃষ্টি তার নেই। হয়তো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করাটাকে উনি পছন্দ করছেন না। আজ ফারাহর বাবার মুখোমুখি হতে কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগছে। ড্রইং রুমে কিছুক্ষণ বসার পর ফারাহর বাবা এলেন।
-তোমাদের পত্রিকার কী অবস্থা? কাটতি কেমন? আমাকে অবশ্য বন্ধুরা পত্রিকার ব্যবসায় নামাতে চায়। আমিই পিছিয়ে যাচ্ছি। আসলে আমিতো এ জগতের মানুষ না। আমার ব্যবসার জগতটাই ভিন্ন। তুমি কি বলো।
-আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এটাও ঠিক আজকাল শিল্পপতিরা টাকার জোরে সব কিছুই করিয়ে নিচ্ছে। আর পত্রিকার ব্যবসাতো মালিকের শুধু অর্থই সর্বস্ব। বাকি কাজতো করেন এমপ্লয়িরা।
-তা হয়তো করেন। তবে অভিজ্ঞতারও তো একটা ব্যাপার আছে।
-তা তোমার অবস্থা কী। এ পেশায় কি নিজেকে সেট করতে পেরেছ?
-মোটামুটি ।
-ভালো করে চেষ্টা চালিয়ে যাও। আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে বলো। আগে জীবনে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হও তাহলে এক সময় সবই পাবে। আর ফারাহর ব্যাপারে তোমার কাছ থেকে আমি সহযোগিতা চাই। মেয়েটা বড় বেশি একরোখা। ওকে তুমি বুঝাও। আমাদের সমাজে মেয়েদের এমন হলে চলে না। জীবনটা কোনো পুতুল খেলা না। আমার জীবনে আমি অন্তত হারে হারে বুঝেছি। সঠিক সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে না পারলে এর ঘানি সারা জীবন টানতে হয়।
-ফারাহরকে আমি কোন দিকটা বুঝাব?
-তোমাকে খোলামেলা ভাবেই বলি। আমি ফারাহকে সারা জীবনে কোনো অভাব বুঝতে দেইনি। তাই আমি ওর বাকি জীবনের সুখটাও দেখতে চাই। তুমিতো জান আমার কোনো ছেলে নেই । ফারাহই আমার সব। ওকে সুখী করতে পারলে আমার জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আর তাই আমি চাই তাকে এমন একজনের হাতে তুলে দিতে যাতে সে বাকি জীবনটা সুখে কাটাতে পারে।
-ঠিক আছে আংকেল আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।
ফারাহর বাবার কথাগুলো অনিন্দ্যের কানে সারাটা পথ ভাসছিল। অনিন্দ্য তার ভাষায় অন্তত এটুকু বুঝেছে তিনি ফারাহর জন্য তাকে মনোনয়ন দেননি। তাতে কি করার আছে অনিন্দ্যের। সে বিষয়টা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু সে কি করবে। সাংবাদিকতা পেশায় পাঁচ বছর হয়েছে। এখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পত্রিকার কাটতিও ভালো না। অনেকেই ভালো অফার নিয়ে অন্য পত্রিকায় চলে গেছে। কিন্তু তার যাওয়া হয়নি। কারো কাছে গিয়ে চাকরি চাইতে তার খারাপ লাগে। নিজেকে ছোট মনে হয়। অনিন্দ্য কারো কাছে চাকরি চাইতে যায়নি। মাঝে একটা অফারও পেয়েছিল। কিন্তু সেখানকার সম্পাদককে সে পছন্দ করে না। লোকটার কোনো নীতি নেই। কারণটা তার কাছে বেশ পরিস্কার। লোকটা এর আগেও পত্রিকা খোলার জন্য কিছু সাংবাদিককে ভালো অফার দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সে পত্রিকাটি বের করেনি। ছয় মাস লাপাত্তা ছিল। পরে জানা গেল এক উঠতি মডেলের প্রেমে পড়ে বিদেশ চলে গিয়েছিল। তাকে বিয়ে ও করেছিল। কিন্তু তার সে সংসার দুমাসও টিকেনি।
জানা গেছে ওই মডেল নাকি কোনো সিনেমার প্রডিউসারের হাত ধরে ভেগে গেছে। লোকটার এটা ছিল তৃতীয় বিয়ে। বিদেশ যাবার আগে যারা তার ওপর ভরসা করেছিল তাদের কেউ কেউ এখনো বেকার। সুতরাং এ ধরনের লোককে বিশ্বাস করাটা বোকামি। অনিন্দ্যকে তিনি ডেকে ছিলেন। অনেক বড় বেতনের অফারও করেছিলেন। কিন্তু সে রাজি হয়নি। লোকটার মুখের ওপর সে বলে এসেছে আগে আপনি ঠিক করেন আপনি এ পেশায় থাকবেন নাকি ধান্দাবাজি করে বেড়াবেন।
বাসায় ঢুকতেই অনিন্দ্য বাবার সামনে পড়ল।
-কি আজ অফিস যাওনি?
-না। ডে অফ ছিল।
-তোমার চাকরি কেমন চলছে?
-ভালো।
-কেমন ভালো?
-মোটামুটি ভালো।
-এ পেশাতেই থাকবে? না অন্য কোথাও চেষ্টা করবে।
-কেন এই পেশাতে সমস্যা কী?
-সমস্যার কথা বলছি না। বলছি এ পেশায় থেকে ভালো করতে পারবে মনে হচ্ছে কি না। হতে পারে না, ভালো না লাগা স্বত্ত্বেও করছ। তা ছাড়া এ পেশাতে তো টাকা পয়সা তেমন নেই। পত্রিকার মালিকরা শুনেছি সব সময় কর্মীদের ঠকাতেই ব্যস্ত থাকে। তাই বলছি যদি তুমিও যদি এমন ভাবো তা হলে আগে ভাগে চেষ্টা কর। সময় হারিয়ে গেলে পস্তাতে হবে।
-দেখি আর কিছু দিন। পরে না হয় অন্য চেষ্টা করব।
-আশরাফ সাহেব কাল ফোন করেছিল।
-চমকে উঠল অনিন্দ্য। কী বলল?
-অনেক কিছুই তো আলাপ হলো। অনেক ভাবনারও উদয় করে দিল। দেখো ফারাহকে নিয়ে তুমি কী ভাবছ? আমাকে একটু খোলাসা করে বলো তো।
-কি বলব। তুমি তো সবই জান। শুধু তুমি না এ ঘরের সবাই জানে ফারাহ কে কি। তারপরও তুমি আমার কাছে কী জানতে চাইছ?
অনিন্দ্যের মা এসে যোগ দিল বাপ ছেলের আলোচনায়।
অনিন্দ্যের মা বলল, দেখ বাবা, তুই আর তোর আপা আমাদের অনেক আদরের সন্তান। তোর বোনোর বিয়ে হয়েছে। সে ভালো আছে। এটা আমাদের অনেক তৃপ্তি দেয়। তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। আমরা তোর সুখ চাই। শান্তি চাই। আমরা চাই এমন একটা মেয়ে এ ঘরে আসবে যে আমাদের সংসারটা আগলে রাখবে। ফারাহ অনেক ধনী ঘরের মেয়ে। হয়তো তোর সঙ্গে সে মানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সংসার জীবনটা অন্য রকম। সে কি আমাদের মতো করে চলতে পারবে? তুই একটু ভাল করে ভেবে দেখ।
অনিন্দ্যের বাবা বললেন, তুমি তাকে অনেক পছন্দ কর ঠিক আছে, সেও হয়তো তোমাকে অনেক পছন্দ করে, কিন্তু তার বাবা চাইছে কি না তাও তোমাকে দেখতে হবে।
- ফারাহর বাবা তোমাকে আর কী বলেছে?
- বলেছে তোমাকে বোঝাতে। তোমার এ রোজগারে ফারাহর সংসার চলবে না। এটা জানাতে।
-ঠিক আছে আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।
(চলবে..)
আরও পড়ুন: