যে ভাবে ২৩ বছর ধরে পালিয়ে ছিল আশিষ চৌধুরী
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আশীষ রায় চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ওইদিন সন্ধ্যার পর থেকে গুলশানে তার বাসা ঘিরে রাখে র্যাব। তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও খালি বোতল ও দু্ই নারীকে আটক করা হয়। এসময় র্যাবের পক্ষ থেকে এক বার্তায় বলা হয়, দীর্ঘ ২৪ বছর আগের বহুল আলোচিত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার পলাতক ও চার্জশিটভুক্ত ১ নম্বর আসামি আশিষ রায় চৌধুরীকে ধরা হয়েছে।
তাকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে, আশিষ রায় চৌধুরী ২৩ বছর ধরে সিস্টেমে পালিয়ে ছিলো। এক পর্যায় এ মামলার আসামিরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে মামলার রায় ও হাইকোর্টের আদেশের কপি আদালতে পৌঁছানো আগেই গায়েব করে ফেলে।
তথ্যমতে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের দিন রাতে সোহেল চৌধুরী তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। এ সময় ভেতরে ঢুকতে তাকে বাধা দেওয়া হয়। পরে রাত আড়াইটার দিকে আবারও তিনি ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সোহেলকে লক্ষ্য করে ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক ও আদনান গুলি চালান। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান সোহেল। এই হত্যাকাণ্ডে আসামিদের মধ্যে আদনানকে ঘটনার পরপরই ধরে পুলিশে সোপর্দ করে জনতা। ওই সময় গুলিতে সোহেল চৌধুরীর বন্ধু আবুল কালাম আজাদ (৩৫) এবং ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মচারী নিরব ও দাইয়ান আহত হন। গুলির শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্পস ক্লাবে ড্যান্স পার্টিতে অংশ নেয়া ২০০ জনের মতো নারী-পুরুষ পালিয়ে যায়।
এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা বলছে, দীর্ঘ ১২ বছর মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকার পর ২০১৫ সালে আদনান সিদ্দিকীর দায়ের করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট রায় দেন। রায়ে ইতিপূর্বে দায়ের করা রুল খারিজ করে দেন। হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার করেন। মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে আইনগত আর কোনো বাধা ছিল না এই আদেশের পর। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই রায় ও হাইকোর্টের আদেশের কপি বিচারিক আদালতে পৌঁছালে। গায়েব হয়ে যায় মামলার নথি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার গায়েব হওয়া নথি খুঁজে বের করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আইনজীবী আবদুল্লাহ আল হারুন রাসেলের জনস্বার্থ মামলা হিসেবে দায়ের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এই হত্যা মামলার নথি গায়েব করার ঘটনা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
রিটকারী আইনজীবী আবদুল্লাহ আল হারুন, ‘হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি ট্রায়াল কোর্টে জানানো হয়নি এবং এর বিচার প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।’ ‘এছাড়া, মামলার নথি বিচারিক আদালত থেকে হারিয়ে গেছে বলে জানা গেছে, যা দুঃখজনক’, বলের এই আইনজীবী।
গত ২৪ মার্চ এ মামলায় আদালতে হাজিরা দেন জামিনে থাকা আসামি ফারুক আব্বাসী। এছাড়া জামিনে থাকা অপর আসামি আদনান সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে হাজিরার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। এসময় আদালত তা মঞ্জুর করেন। আর কারাগারে থাকা আসামি তারিক সাঈদ মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। তবে এই মামলায় পলাতক রয়েছেন আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সানজিদুল হাসান, সেলিম খান ও হারুন অর রশিদ। তাদের বিরুদ্ধে আদালত ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলছে। এ মামলার বিষটি সামনে আসার পর গুলশানে ৩০ মার্চ থেকে আত্মগোপনে থাকেন গ্রেপ্তারকৃত আশিষ।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত ২৮ মার্চ তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। ৩০ মার্চ থেকে এই বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গুলশানের এক বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাসা মিরপুর ডিওএইচএস। এই বাসাটি আত্মগোপনের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল দেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে আশিষ চৌধুরী। আশিষকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেন এক হোটেলের এমডি। বিদেশে যাওয়ার জন্য তার বিমানের টিকিট কাটা ছিল। তাছাড়া এ মামলার তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি ওই দিন ক্লাবের অসামাজিক কাজে বাঁধা দেওয়ায় খুন হয় চিত্রনায়ক সোহেল। মূলত খুনিরা ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে নায়ক সোহেলকে হত্যা করে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানীর ক্লাব ট্রামসের নিচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা করেন নিহতের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ওই মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে এ মামলার কাগজ পত্র আদালত থেকে লাপাত্তা হয়ে যায়। চলতি বছরে এ মামলা নিয়ে আবারও আদালত রায় দেয়, পরে গা ঢাকা দেয় এ মামলার আসামি আশিষ রায় চৌধুরী। আদালতের ওয়ারেন্ট থাকায় গুলশানের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।