পশ্চিমা অবরোধে রাশিয়ার যত ক্ষতি
ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পর প্রতিউত্তরে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অবোরধ আরোপ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো ২০১০ সালে ইরান ও ২০১৩ সালে উত্তর কোরিয়ার ওপর যে ধরনের আবরোধ অরোপ করেছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার চেয়েও কঠোর আবরোধ আরোপ করা হয়েছে।
পশ্চিমা নেতারা জানেন বিশ্বের বৃহত্তম আর্থনীতির এই দেশটিকে অবিলম্বে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা যাবে না, তবে এই অবরোধ আরোপের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতির যথেস্ট ক্ষতি হবে। এক্ষতি এড়াতে রাশিয়া দ্রুততম সময়ে যুদ্ধ থেকে সরে আসলে আসতেও পারে।
রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো কতটা কঠিন? ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়েছিল এবারের নিষেধাজ্ঞা তার চেয়েও কঠিন। এ অবরোধ রাশিয়ান অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারবে তবে, নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে নতুন রাশিয়া ভূখণ্ড হারালেও এর জনগণ সেখানেই আছে। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের রুশভাষী দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে নিতে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক সংঘাত বিরাজ করছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এক টেলিভিশনে ভাষণে পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেন এক সময় রাশিয়ার ভূমি ছিল। তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, রাশিয়ার জনগণ তার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবে। দীর্ঘ ভাষণে পুতিন ওই অঞ্চলের ইতিহাস তুলে ধরেন। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়েও কথা বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও অংশীদারেরা ইতিমধ্যে পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব কঠিন অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। কার্যকরভাবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি রাশিয়ার ওপর একটি বিরাট আঘাত।
নিঃসন্দেহে রাশিয়ান আর্থিক ব্যবস্থার সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাত হল সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশিয়ার (সিবিআর) উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। দেশীয় বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই দেশীয় বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে সেটা প্রভাব ফেলে। এর ফলে দুদিন আগের তুলনায় ডলার বিক্রির হার অন্তত ৪৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলোতে ডলার বেচাকেনা হারের ব্যবধান ছিল ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে।
রবিবার রাত থেকে রাশিরার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বেশ কয়েকটি নতুন প্রবিধান জারি করেছে। রপ্তানিকারকদের এখন রুবলের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৮০ শতাংশ বিক্রি করতে হবে। বিদেশিরা রাশিয়ান স্টক এবং বন্ড বিক্রি করতে পারে না এবং তাদের অ্যাকাউন্টে কুপন এবং লভ্যাংশ স্থানান্তর করতে পারে না। আবাসিক বা অনাবাসিক ৪৩ টি দেশের নাগরিক, যে সকল দেশ রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করেছে, তারা রাশিয়ার বাইরে কোনো ব্যাংকে তাদের টাকা স্থানান্তর করতে পারবে না। কার্যকরভাবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি রাশিয়ার ওপর একটি বিরাট আঘাত।
সিবিআর-এর উপর নিষেধাজ্ঞার একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি, চলতি হিসাব এবং জাতীয় কল্যাণ তহবিলের তহবিল জব্দ করা। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
সুইফট থেকে রাশিয়ান ব্যাংক বিচ্ছিন্ন-
রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা খুব দ্রুত কার্যকর হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারি নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। ব্যাঙ্কিং সিস্টেম সুইফট জানিয়েছে, আগামী ১২ মার্চ থেকে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কার্যকর শুরু করবে। প্রাথমিকভাবে সাতটি রাশিয়ান ব্যাংককে তারা বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুঃখজনক মানবিক পরিণতি যারা ভোগ করছেন তাদের প্রতি আমাদের সমবেদনা।’ এই সপ্তাহের শুরুতে পশ্চিমা দেশগুলো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম থেকে রাশিয়ার কিছু মূল ব্যাংককে বাদ দিতে সম্মত হয়। আন্তঃসীমান্ত অর্থ প্রবাহের সুবিধার্থে ২০০টিরও বেশি দেশে হাজার হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফট ব্যবহার করে।
রাশিয়ায় প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি বন্ধ-
রাশিয়ায় মূল প্রযুক্তিপণ্যগুলোর রপ্তানি বন্ধ করতে পারে পশ্চিমা দেশগুলো। এসব পণ্যের মধ্যে থাকতে পারে সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ। গাড়ি থেকে শুরু করে স্মার্টফোন সবকিছু তৈরি করতেই প্রয়োজন এই মাইক্রোচিপের।
প্রযুক্তিপণ্যগুলো হাতে না পেলে যেমন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ গবেষণা খাত ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনই ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। একই সঙ্গে রাশিয়ায় এসব পণ্য রপ্তানিকারী দেশগুলোর ওপরও প্রভাব আসবে।
রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি বন্ধ-
প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল রপ্তানির ওপর রাশিয়ার অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে গাজপ্রম ও রসনেফটের মতো দেশটির বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনা বন্ধ করতে পারে পশ্চিমারা।
রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করলে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে, দেখা দিতে পারে তেলের সংকট। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি। রাশিয়া থেকে আমদানি করা গ্যাসেই দেশটির তিন ভাগের একভাগ চাহিদা মেটে।
এছাড়া প্রাইভেট কোম্পানি অ্যাপল, অ্যামাজন ও নাইকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। তারা ঘোষণা দেয়, রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদ হিসেবে তারা এটা করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়া আউটলেট আরটি এবং স্পুটনিকের সম্প্রচার ইউরোপজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) নিষিদ্ধ হওয়ার পর মিডিয়াগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি এবং মিথ্যা প্রচারণার অভিযোগ আনা হয়।
কেএফ/