বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর নির্মাণ করবে দুবাই, যা যা থাকবে?
ছবি সংগৃহিত
আল মাকতুম ইন্টারন্যাশনালের কাজ শেষ হয়ে গেলে এটি বছরে ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রীর পাশাপাশি ১২ মিলিয়ন টন মালামাল পরিবহণ করতে সক্ষম হব। এক দশকেরও বেশি আগে দুবাই প্রথমবারের মত বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর হিসেবে আল মাকতুম ইন্টারন্যাশনালের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল।
২০১৩ সালের অক্টোবরে বুদাপেস্ট থেকে আগত উইজ এয়ার এ৩২০ প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী ফ্লাইট হিসেবে আল মাকতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (যা দুবাই ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল নামেও পরিচিত) পৌঁছে খবরের শিরোনাম হয়েছিল।
দুবাই শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নতুন এই 'গ্রিনফিল্ড' বিমানবন্দরটিকে ভবিষ্যতে বিশ্বের বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম বিমানবন্দর বানানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
দুবাই ইন্টারন্যাশনাল (ডিএক্সবি) এবং নতুন বিমানবন্দরটি পরিচালনার দায়িত্বে আছে দুবাই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, আল মাকতুম ইন্টারন্যাশনালের কাজ শেষ হয়ে গেলে এটি বছরে ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রীর পাশাপাশি ১২ মিলিয়ন টন মালামাল পরিবহণ করতে সক্ষম হবে। .
এটি বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দর হবে যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন আটলান্টা ইন্টারন্যাশনালের তুলনায় প্রায় ৬৩ মিলিয়ন বেশি যাত্রী পরিবহনে সক্ষম হবে।
প্রাথমিক যাত্রীবাহী ফ্লাইটের প্রায় এক দশক পরে এবং মহামারির জন্য ১৩ বছর পরেও দুবাইয়ের নতুন বিমানবন্দরটির কাজ এখনো চলমান।
'ভবিষ্যতের এয়ারপোর্ট'
২০২৩ সালে আল মাকতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুষ্ঠিত 'দুবাই এয়ার শো' বিমানবন্দরটি সম্পর্ক কিছু চমকপ্রদ ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি এটার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা কৌতূহলও তৈরি করতে সক্ষম হয়।
দুবাই বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী পরিচালক পল গ্রিফিথস সিএনএনকে জানিয়েছেন, "আমরা আমাদের গ্রাহকদের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিকল্পনা মেটাতে ডিএক্সবিকে সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। সকল সম্ভাব্যতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি চলতে থাকবে।"
গ্রিফিথস আরো জানিয়েছেন, "পরিকল্পনা হল, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং মাধ্যমে ডিএক্সবির বর্তমান ক্ষমতা সর্বাধিক করা।"
তিনি বলেছেন, ডিএক্সবির বর্তমানে ১০০ মিলিয়ন যাত্রী ধারণ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে সেটিকে ১২০ মিলিয়নে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
তিনি আরো বলেন, "আমরা আমাদের বিমানবন্দরকে আরও বড় করে তুলছি কারণ আরও বেশি লোক এটি ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ২০২৩ সালে আমাদের ধারণা অনুযায়ী প্রায় ৮৬.৮ মিলিয়ন মানুষ এটি ব্যবহার করেছে। আমরা ধারণা করছি, ২০২৪ সালে প্রায় ৮৮.২ মিলিয়ন এবং ২০২৫ সালে প্রায় ৯৩.৮ মিলিয়ন যাত্রী এটি ব্যবহার করবে।"
গ্রিফিথস নির্দিষ্ট কোন সময়ের কথা না বললেও জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজন হতে পারে অধিক ব্যস্ততার জন্য। তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার পাশাপাশি এটিকে 'রোমাঞ্চকর সম্ভাবনা' বলে অভিহিত করেছেন।
দুবাই এয়ার শোতে গ্রিফিথস সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তারা ইতোমধ্যেই নতুন বিমানবন্দরের জন্য ডিজাইন তৈরি করেছেন। এয়ার শোতে সবাইকে বিমানবন্দরের যে বড় মডেলটি দেখানো হয়েছিল, সেটি কিছুটা পুরনো হলেও সেটি থেকে নতুন বিমানবন্দরে ছয়টি রানওয়ে এবং তিনটি বড় টার্মিনাল থাকার বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
নতুন বিজনেস মডেলের আবির্ভাব
বিমানবন্দরটি দুবাই সাউথ নামে একটি বড় প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু হবে। প্রকল্প অনুযায়ী, দুবাইয়ের ঠিক দক্ষিণে মরুভূমির ১৪৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন শহর তৈরি করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।
এই নতুন পরিকল্পনার কিছু অংশ ইতোমধ্যেই আকার নিতে শুরু করেছে। এখানে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকা মিলিয়ে আটটি অঞ্চল বানানো হবে যার প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি সহ অন্য কাজের জন্য বরাদ্দ করা
বিমানবন্দরটিকে পুরো পরিকল্পনার কেন্দ্রে রেখে একটি সম্পূর্ণ 'অ্যারোট্রোপলিস' বানানো হবে। সম্প্রতি ৯৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এমিরেটস ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টার সহ দুবাইয়ের বিমান চলাচল এবং মহাকাশ শিল্প ইকোসিস্টেমের আয়োজক মোহাম্মদ বিন রশিদ (এমবিআর) এরোস্পেস হাব এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
স্থানীয় বৃহত্তর বিমান পরিবহণ সংস্থা এমিরেটস এবং এটির ছোট অংশীদার ফ্লাইদুবাই পূর্বের দুবাই ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর থেকে নতুন বিমানবন্দরে স্থানান্তরিত হলেই বড় পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপটি দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও কবে সেটি ঘটবে তা এখনো অনিশ্চিত।
ইংল্যান্ডের সারে ইউনিভার্সিটির বিমান পরিবহণ ব্যবস্থাপনার প্রোগ্রাম লিডার নাদিন ইতানির মতে, এমিরেটসের ডিডব্লিউসিতে তে স্থানান্তরিত হওয়া মানে এর সাথে অনেক কিছু স্থানান্তর করা।
তিনি বলেন, "এটি বৈশ্বিক বিমান ভ্রমণ এবং বৈশ্বিক বাজারের বদলে যাওয়া গতিশীলতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি কৌশলগত পুনর্বিন্যাস"
এই অঞ্চলে বর্তমানে নতুন এবং বড় বিমানবন্দরগুলোতে বিনিয়োগ করার জন্য একটি প্রতিযোগিতা চলছে এবং এতে কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না।
এই অঞ্চলের বিমান সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের অংশ হতে চায় এবং যেই শহরকেন্দ্রিক কার্যক্রম চালায় সেই শহরকে বাণিজ্যের জন্য বড় করে তুলতে চায়৷ পাশাপাশি ভ্রমণের জন্য শহরকে একটি ভালো গন্তব্য হিসেবে প্রস্তুত করতে চায়। এর জন্য নতুন এবং চমকপ্রদ বিমানবন্দর একটি ভালো প্রচেষ্টা।
২০১৪ সালে উদ্বোধন করা কাতারের হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দুবাইয়ের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এটি বার্ষিক ৬০ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহণ করতে আগ্রহী।
এই অঞ্চলে আরো বড় বড় বিমান বন্দর চালু হয়েছে এবং অনেক বিমানবন্দরকে বেশী যাত্রী ধারণ করতে পারার জন্য নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ২০১৮ সালে ওমানের মাস্কাটে ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন বিমানবন্দরের উদ্বোধন, ২০২১ সালে বাহরাইনে ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন টার্মিনাল তৈরি এবং সম্প্রতি ২০২৩ সালের নভেম্বরে আবুধাবির ৭ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে নির্মিত নতুন টার্মিনাল 'এ' যেটি একসাথে ৭৯টি বিমান পরিচালনা করতে সক্ষম।
উপসাগরের উত্তর প্রান্তে কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিখ্যাত ব্রিটিশ আর্কিটেকচারাল ফার্ম ফস্টার+পার্টনার্স দ্বারা ডিজাইন করা একটি নতুন টার্মিনাল তৈরি করছে যা প্রাথমিকভাবে প্রতি বছর ২৫ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহণ করার ক্ষমতা রাখবে। ভবিষ্যতে এটি দ্বিগুণ করে ৫০ মিলিয়ন পর্যন্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুবাইয়ের কেন্দ্রস্থল থেকে ২০ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত শারজাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বার্ষিক ২০ মিলিয়ন যাত্রী ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
সৌদি আরব ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে একটি বিশাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ করছে যা দেশটির বিমান যোগাযোগকে এগিয়ে নিতে এবং এটিকে বিশ্বের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্যগুলোর একটিতে পরিণত করবে। এটি বাস্তবায়নে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।
তাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।