তিস্তায় আরো দুটি কৃত্রিম খাল ও দুটি জলবিদুৎ তৈরি করছে ভারত
প্রতিবেশী দেশ ভারত তার কৃষি ব্যবস্থার জন্য আন্তঃসীমান্তের নদী তিস্তার জলকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় চোখ তুলে তাকিয়েছে। বাংলাদেশ বলছে, এটি উদ্বেগজনক যেহেতু নদীটি যৌথ ও এর গতিপথ পরিবর্তন বাংলাদেশের নিচুব্যবস্থার কৃষিজমিগুলোর সর্বনাশ ডেকে আনবে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদুলু এজেন্সিকে শুক্রবার (১৭ মার্চ) কথাগুলো বলেছেন ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ভারতের কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে একটি রাষ্ট্রীয় পত্র প্রেরণ করবে। যেখানে প্রতিবেশী দেশটি অন্বেষণ করবে স্বাদু ও পরিস্কার পানিকে ভাগ করার ব্যাখ্যা।
গেল সপ্তাহে একটি ভারতীয় দৈনিক খবর প্রকাশ করেছে, পশ্চিমবঙ্গের জলসেচ বিভাগ আনুমানিক ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে আরও দুটি বিরাট আকারের কৃত্রিম খাল খননের জন্য যাতে এই তিস্তা নদীর বাঁধে সেগুলো তৈরির মাধ্যমে তাদের কৃষিগত বিষয়গুলো সম্পাদন করতে পারে। এই নতুন প্রকল্পটির মাধ্যমে ভারত তার হিমালয়ের তীরের পশ্চিমবঙ্গীয় শহর দার্জিলিংয়ে আরও তিনটি জলবিদুৎ প্লান্টও তৈরি করবে। যেগুলোর দুটিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহিত হবে বলে খবর প্রকাশ করেছে দেশটির দৈনিক টেলিগ্রাফ।
বাংলাদেশের খবরের বিস্তারিত হলো, দেশটি ভারতকে একটি ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য লিখতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ও সেখানে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করবে এই সবগুলো প্রকল্প সম্পর্কেই যেগুলোতে ভারত সরকারের এই যৌথ নদীটির পানিগুলোতে তাদের দিকে কৃষির কাজে ব্যবহারের জন্য নেবার প্রশ্নগুলোও থাকবে।
৪১৪ কিলোমিটার বা ২৫৭ মাইলের তিস্তা নদীটি হিমালয়ের ভারতীয় পশ্চিম অংশ থেকে জন্মেছে ও বাংলাদেশের উত্তর অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মোট ৫৭টি আন্ত:সীমান্ত নদী রয়েছে। তার ৫৪টিই ভারত ও বাকি তিনটি মিয়ানমারের ভেতর থেকে এসেছে।
যৌথ নদী কমিশনের সিনিয়র সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন আরও বলেছেন, 'তারা (ভারত) আমাদের জানানো উচিত ছিল। তবে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনোকিছুই জ্ঞাত হইনি। এর ফলে আমরা একটি ‘ডেমি-অফিশিয়াল লেটার’ আমাদের ভারতীয় পক্ষকে প্রেরণ করবো, যেখানে এই বিষয়ের মূল জিজ্ঞাস্যগুলো থাকবে ও মূল বিষয়গুলোতে প্রশ্ন করা হবে এবং আমরা আমাদের উদ্বেগ ও সংকট জানাবো, যেগুলোর মধ্যে এমন একটি উদ্যোগ বাংলাদেশে তিস্তার নিম্মধারা কিভাবে প্রভাব ফেলবে সেটিও লেখা হবে।'
‘যৌথ নদী কমিশন সাধারণত বাংলাদেশের মোট ৫৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমিকে শুকনো বা গ্রীষ্মকালীন মৌসুমগুলোতে কৃষি কাজের জন্য পানি সরবরাহ করে। তবে এই বছর মোটে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পানি প্রবাহিত করতে পেরেছে। এর কারণ হলো তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহই ছিল না। এর পেছনে তিন্তা নদীতে বাঁধের পাশাপাশি আরো দুটি কৃত্রিম খালের কাজ’ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
তিস্তা নদী বাঁধ প্রকল্প মোট ২৭ মাইল বা ৪৪ কিলোমিটার জুড়ে, সেটি বাংলাদেশের নীলফামারীর উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত। এই প্রকল্পটিকে ভারত ১৯৭৯ সালে চালু করেছে।
‘ভারতের ওপরের অংশ থেকে নিম্মধারায় বাংলাদেশী প্রবাহিত তিস্তা নদীটি দেশটির পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও তাদের জলসেচের কার্যক্রমের জন্য শুকনো বা গ্রীস্মকালীন মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে প্রায় মরে যায়’ এই কথাগুলোর উল্লেখ করে মোহাম্মদ আবুল হোসেন আরো জানিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতে এই নদীটির পানিকে যদি ভাগ করে ফেলা হয় তার ফলে তিস্তার পুরো বাস্তুসংস্থানই তার নিম্মধারায় প্রবলভাবে ভুগবে।’
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের একেবারে কম পানি প্রবাহও থাকে না তিস্তা নদীতে শুকনো মৌসুমে, আমরা প্রাপ্য পাই না। তখন কোনো পানি, কোনো মাছ খুঁজে পাওয়া যায় না নদীটিতে। কেবল অসংখ্য চর বা বালির সৈকত থাকে ওপরের প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত ভারতীয় নদী অংশের পানির ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে।’
মোহাম্মদ আবুল হোসেন উল্লেখ করেছেন, ‘তারা জোর করে এই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করেছে।’
বাংলাদেশের নৌমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও জানিয়েছেন, ভারতের তিস্তা নদীর ওপর নতুনভাবে দুটি বিরাট কৃত্রিম খাল খনন ও দুটি জলবিদুৎ প্রকল্প তৈরির কাজে বাংলাদেশের উদ্বেগ রয়েছে। তিনি রাজধানী ঢাকাতে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাদের সরকার এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা প্রদান করতে নয়াদিল্লীকে বলবে।
সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শেহেলি সাবরিন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ও ভারতের সাড়া প্রদানের ওপর ভিত্তি করে সঠিক অ্যাকশনে যাবে।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর বারবার নিশ্চয়তা প্রদান সত্ত্বে, যেগুলোর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আশ্বাস ও নিশ্চয়তা রয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিরোধ হলেও বাংলাদেশ গত ১২ বছর চেষ্টা করেও দীর্ঘকালের পানি-ভাগাভাগির চুক্তিটি প্রতিবেশী ও বড় দেশ ভারতের সঙ্গে করতে পারেনি।
বাংলাদেশের ১১টি ছোট নদী যেগুলোর বেশিরভাগ উত্তরের জেলাগুলোতে প্রবাহিত, সেগুলো তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এই নদীর পানি প্রবাহ থেমে যাওয়ায় এই নদীগুলোও মারা যাচ্ছে। এর কারণও হলো, ওপরের ভারতীয় অংশে প্রবাহিত ধারাগুলোতে স্বজ্ঞানে দেশটি পানি প্রবাহ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বাঁধ দিয়ে ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে পানি চুক্তি করতে অস্বীকার করছে বা রাজি হচ্ছে না অথবা এগিয়ে আসছে না।
ওএফএস/এএস