ফিরে দেখা ২০২১
জলবায়ু সম্মেলনেও পরিবেশ বিনাশকারীদেরই দৌরাত্ম্য
পৃথিবী বাঁচাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে অনেদিন ধরে চলছে বিভিন্ন পরিকল্পনা। ফসিল ফুয়েল, বিশেষ করে কয়লা থেকে সরে আসতে আহ্বান করা হয়েছে অধিক কয়লা ব্যবহারকারী দেশগুলোকে। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আর অর্থায়নের বিষয়ে চুক্তিও হয়েছে আগে।
এসব ইস্যুতে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের ৩১ অক্টোবর সম্মেলন শুরু হয়ে চলে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। যেখানে একত্রিত হয়েছিলেন বিশ্ব নেতা, পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
দুই সপ্তাহের দীর্ঘ আলোচনার পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি গ্লাসগো চুক্তি। লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনা। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান উৎস কয়লার ব্যবহার বন্ধ এবং এ খাতে সরকারের ভর্তুকি কমানো। কপ-২৬ এর আলোচনার খসড়া চুক্তিতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ভারত ও চীনের বিরোধিতার কারণে চূড়ান্ত চুক্তিতে রাখা হয়নি। কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ না করে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে। বর্তমান প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে বলে ধরণা পরিবেশবিদদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী কয়লা। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামাতে হবে।
গ্লাসগো চুক্তিতে জরুরি ভিত্তিতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আরও আর্থিক সহায়তার আহ্বান করা হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থ সহায়তা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে এই প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সন্দিহান পরিবেশবিদরা।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, 'আমাদের ভঙ্গুর গ্রহটি একটি সুতোয় ঝুলছে। আমরা এখনও জলবায়ু বিপর্যয়ের দরজায় কড়া নাড়ছি। এটি জরুরি পদক্ষেপে যাওয়ার সময়। নতুবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা শূন্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যাবে।'
সুইস পরিবেশমন্ত্রী সিমোনেটা সোমারুগা হতাশার সুরে বলেন, 'আমরা গভীর হতাশা প্রকাশ করছি। কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকিতে আমরা যে লক্ষ্যে একমত হয়েছিলাম তা একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ফলে আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই চুক্তি আমাদের ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির কাছাকাছি নিয়ে আসবে না, বরং এ সিদ্ধান্তে লক্ষ্যে পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে যাবে।'
পরিবেশবাদীদের মতে, '১ দশমিক ৫ ডিগ্রি’ শব্দটি বলা অর্থহীন যদি চুক্তিতে এটি অর্জনের কোনো উপায় বা উপাদানের কথা না থাকে। কপ-২৬ দক্ষিণের দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর বলেও আখ্যায়িত করছেন কেউ কেউ।
কয়লা ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতা থাকলেও কিছু পর্যবেক্ষক চূড়ান্ত চুক্তিটিকে একটি বিজয় হিসেবে দেখছেন।
তাদের মতে, প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নথিতে এই ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি বা কয়লার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সকলের প্রতি আশা ব্যক্ত করে বলেন, 'বিশ্ব গ্লাসগো সম্মেলনকে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাপ্তির সূচনা হিসেবে দেখবে।' চুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি কিছু করার আছে। আজকের চুক্তিটি একটি বড় পদক্ষেপ। কয়লার ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি এটি এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় সীমাবদ্ধ করার একটি রোডম্যাপ।'
মার্কিন জলবায়ু বিষয়ক দূত জন কেরি বলেন, 'আসলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন এড়াতে পরিষ্কার বায়ু, নিরাপদ জল এবং একটি স্বাস্থ্যকর গ্রহ সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি।'
চুক্তিতে শুধু কয়লার কথা বলা হলেও তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানির বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। এ বিষয়েও সমালোচনা করছে অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন।
অ্যাকশন এইডের নীতি সংক্রান্ত পরিচালক লারস কচ বলেন, 'জ্বালানির মধ্যে শুধু কয়লার উল্লেখ করা হতাশাজনক। এতে ধনী দেশগুলোকে বিনামূল্যে পাস দেওয়া হলো। যারা তেল ও গ্যাস উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে।'
কয়লা 'ফেইস আউট' থেকে 'ডাউন':
এবারের সম্মেলনে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতির প্রত্যাশা করেছিল সবাই।
খসড়া চুক্তিতে ২০৫০ সালের পর কয়লা 'ফেইস আউট' হবে এমন ভাষা পরিবর্তন করে 'ফেইস ডাউন' ব্যবহার করা হয়েছে। এর পেছনে ছিল ভারত ও চীনের বিরোধীতা।
খসড়া চুক্তিতে কয়লা ব্যবহার বন্ধে সরকারি ভর্তুকি বাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথায় ভারত ও চীন বিরোধিতা করে। যার ফলে চুড়ান্ত চুক্তিতে তা রাখা সম্ভব হয়নি।
চীন আর ভারতের বক্তব্য হচ্ছে কয়লা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। কাজেই তারা সময় চাচ্ছে।
ভারতের জলবায়ু মন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশগুলো কীভাবে কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে? যেখানে দেশগুলো এখনও উন্নয়ন এজেন্ডা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের সঙ্গে মোকাবেলা করে যাচ্ছে।'
ভারত বলছে, তাদের ২০৭০ সাল লাগবে। প্রত্যাশা ছিল তাদের ২০৫০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসার।
কয়লা থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে হতাশা দেখা দেয় মারাত্মক। তারপরও কয়লা নিয়ে একেবারে আশাহত নন বিশেষজ্ঞরা।
সম্মেলন শেষে জলবায়ু বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার ফ্রানস টিমারম্যানস তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, 'আমি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলাম যে, কয়লা 'ফেইস আউট' শব্দ ব্যবহারের কারণে। কিন্তু তারপরও যেটা হলো আমি বলব ২৪ ক্যারটের পরিবর্তে ১৮ ক্যারট গোল্ড। তবুও এটি স্বর্ণ। অর্থাৎ জ্বালানি হিসেবে কয়লা থেকে সরে আসার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ এটি।'
তার মতে, 'যেখানে ছয় মাস আগেও চীন ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ কয়লার ক্ষতির বিষয়টি মানতেই নারাজ ছিল। কিন্তু আইপিসিসি রিপোর্ট দেওয়ার পর এখন সবাই একমত যে আমরা গভীর সংকটে। ওই দেশগুলো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে।'
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে বাংলাদেশ। এবারের সম্মেলনে সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৮ দেশের জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি বাংলাদেশ।
টিটি/