আর্থিক ও জ্বালানি সংকটে নেপাল কী শ্রীলঙ্কার পথে?
নেপালে এখন তীব্র জ্বালানি তেলের সংকট, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ভয়াবহ রকমের বেড়েছে। সমস্যায় নেপালের আম আদমি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশটিতে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা সংকট দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে–শ্রীলঙ্কার পরিণতি হতে চলেছে নেপালের।
আকাশ ছুঁয়েছে জ্বালানির দাম। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। কাঠমান্ডুর রপ্তানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকায় বর্তমানে বিলাসবহুল সামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধ করার সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্ত বিশ্বের নজর কেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানির খরচ কমাতে সরকারি দপ্তরগুলো দু’দিনের ছুটি ঘোষণা করার কথা ভাবছে নেপাল।
নেপালের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও নেপাল অয়েল করপোরেশন সরকারকে দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছে।
একদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে। ফলে বেড়েছে অপরিশোধিত তেলের দাম। এ ছাড়া তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশ, যেমন ইরান ও ভেনিজুয়েলা থেকেও তেল বিক্রিতে বিধি-নিষেধ রয়েছে।
অন্যদিকে, পর্যটননির্ভর নেপাল করোনা মহামারির ফলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ স্থগিত ছিল। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে মন্দা দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে ভুগছে নেপাল। ঘোরাল পরিস্থিতিতে ডলারের বদলে তেল কিনতে ব্যর্থ নেপাল সরকার। ভুগছে সে দেশের মানুষ।
নেপালের অর্থনীতিবিদ ড. পোশ রাজ পাণ্ডে বলেন, করোনায় লকডাউনের কারণে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এসবের কারণে নেপালে অতিরিক্ত প্রায় ১২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
এর আগে অয়েল করপোরেশন ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করার জেরেই সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করছে সরকার।
সরকারের মুখপাত্র জ্ঞানেন্দ্র বাহাদুর কারকি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নেপালের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও নেপাল অয়েল করপোরেশনের তরফে সরকারকে দেওয়া পরামর্শের উপর এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রস্তাব বিবেচনাধীন।
বৈদেশিক মুদ্রা সংকট মোকাবিলা করার জন্য নেপাল সরকার বিদেশে বসবাসরত নেপালি নাগরিকদের দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলারে অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছে।
দ্য ফ্রি প্রেস জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২১ সালে শ্রীলঙ্কা সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে দেশটির অর্থনীতি আজ অস্থিতিশীল অবস্থা। আর নেপালে গত বছর তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকট দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করেছে বলে ধারণা করা হয়।
নেপাল সরকার তাই বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে বৈদেশিক মুদ্রার (ফরেক্স) রিজার্ভের পতন ঠেকানোর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখন সরকার এই সমস্যার সমাধানের লক্ষে বিলাসবহুল সকল পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এছাড়া গত ১০ এপ্রিল পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মহা প্রসাদ অধিকারীকে বরখাস্ত করা হয়।
নেপালের জাতীয় দৈনিক পত্রিকা মাইরিপাবলিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুখপাত্র গুনাকর ভট্ট বলেন, বর্তমানে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ফরেক্স রিজার্ভ যথাযথ বজায় রাখা এবং এর পতন রোধ করা।
তিনি আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান ঘাটতি এবং অধিক আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন রোধ করতে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি বন্ধ করা হয়েছে।
নেপালের বার্ষিক আমদানি বিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ট্রিলিয়ন-রুপির মার্ক অতিক্রম করেছে। তাছাড়া ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পরে পুনর্গঠন অভিযান এবং রেমিট্যান্স আয় হ্রাসের কারণে এমন পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছিল।
এর তিন বছর পর মাত্র ছয় মাসে কোভিডের বিধ্বংসী প্রভাব থেকে দেশকে পুনরুদ্ধার করতে বিদেশি পণ্য কিনতে এক ট্রিলিয়ন রুপি খরচ করে নেপাল।
এছাড়া কেপি শর্মা অলি সরকারের পতনের পরেই দেশে রাজনৈতিক সংকটের কারণে গত বছরের জুলাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে শুরু করে। পর্যটন ও রপ্তানি থেকে আয় এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়ার পর থেকে আমদানি বেড়ে গেছে এবং আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ।
নেপালের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী পণ্য, সয়াবিন তেল এবং পাম তেল। যদিও নেপাল সামান্য পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদন করলেও পাম তেল উৎপাদন করে না। এখানে আমদানিই রপ্তানি। দেশটি সাফটা বা দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা চুক্তির সুবিধা পায় বলেই তেল আমদানি করার পর তা আবার রপ্তানির মাধ্যমে আয় করে থাকে।
নেপাল তার ক্রম হ্রাসমান রিজার্ভ বজায় রাখতে দামি গাড়ি, সোনা এবং অন্যান্য বিলাসবহুল পণ্যের আমদানিও কঠোর করেছে। কারকি বলেন, সরকার আমদানিকৃত যানবাহন এবং এই জাতীয় অন্যান্য পণ্যের উপর শুল্ক কমাতে পারে কি না তাও খতিয়ে দেখছে।
এসএ/