ডনের সম্পাদকীয়
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পাকিস্তান
সম্প্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান সরকারের পতন হয়। ক্ষমতায় আসে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। তবে এ সরকারের সামনে রয়েছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কা। পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক ডনের সম্পাদকীয়তে এ অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলো তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, যে কোনো হিসাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। নতুন সরকারকে এখনই সংকট থেকে উত্তরণে কাঠামোগত সংস্কারে হাত দিতে হবে।
শাহবাজ শরিফের নতুন জোট সরকার এমন এক অর্থনীতি পেয়েছে, যেখানে মুদ্রাস্ফীতি চরম রূপ নিয়েছে। ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতি, বিনিময় ভারসাম্যহীনতা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সংকট দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী শওকত তারিনের যুক্তি, ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় তেহরিক-ই-ইনসাফ যে অর্থনীতি পেয়েছিল, সেটিকে আরও ভালো অবস্থায় রেখে যাওয়া হয়েছে। যা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অর্থনীতিকে আরও উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া কিংবা মুদ্রাস্ফীতিতে-জর্জরিত নাগরিকদের দ্রুত স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা নতুন সরকারের জন্য একটি ভয়ানক কঠিন কাজই হবে। তাই বলে পরিস্থিতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কোনোভাবেই সহায়ক হবে না। বরং তাতে জটিলতা আরও বাড়বে।
মঙ্গলবার তাড়াহুড়ো করেই একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন পাকিস্তানের অর্থ উপদেষ্টা হতে যাওয়া মিফতাহ ইসমাইল। এতে দুই অর্থবছরের রাজস্ব হিসাব ও বিনিময় ভারসাম্যহীনতার ঘাটতি নিয়ে তিনি কথা বলেন। ঘটনার উপরের দিক হচ্ছে এটি। কিন্তু এ রকম বাড়াবাড়ি আমরা আগেও দেখেছি। প্রতিটি নতুন সরকারই অপ্রয়োজনীয়ভাবে পূর্বসূরিদের সুনামহানি করতে অর্থনৈতিক সংকটকে বাস্তবতার চেয়ে আরও বড় করে তুলে ধরে আসছে।
বর্তমান সময়ে পাকিস্তানে চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু মিফতাহ ইসমাইলের দাবি অনুসারে বর্তমানে সেই ভারসাম্যহীনতা দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছানো অসম্ভব।
সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।
পাকিস্তানের রাজস্ব ঘাটতিও দিনে দিনে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। আর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছয় শতাংশের কিছুটা বেশি হতে পারে। আগের সরকারের আমলেও ঠিক এই হিসাব করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি রাজস্ব বছরে তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে বলে দাবি করা একটু অতিরিক্তই হয়ে যাবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমান অর্থবছরে পাকিস্তানের বাহ্যিক অর্থায়ন পরিচিত উৎসগুলো থেকেই পুরোপুরি পূরণ করতে হবে।
দেশটির অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ যে অর্থনীতি পেয়েছিল, বর্তমানে তা আরও খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। এই ঘটনাকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। আগের সরকার তৃতীয় দফায় ধনীদের কর মওকুফ করায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দিতে বিলম্ব করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা।
চীনও আড়াইশ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেও সময় নিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যখন প্রত্যাশামতো ফিরে আসে, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছে অঙ্গীকার রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেন মিফতাহ ইসমাইল। চীনও সাহায্যের হাত বিস্তৃত করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতিকে জোরালোভবে পুনরুজ্জীবিত করতে পাকিস্তানের নতুন শাসকেরা বড় কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে কিনা। তা নিশ্চিত করতে হলে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় আরও সম্প্রসারিত করতে হবে, ক্ষমতাবানদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। তাদের কাছ থেকে যথাযথভাবে কর আদায় করতে হবে। ধনীরা যাতে কর না দিয়ে রেহাই পেয়ে না যান।
আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতে স্টিল মিল ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণ করতে হবে।
রফতানি চাঙ্গা করাসহ আমদানির অর্থ পরিশোধের জন্য উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়াতে শাসন ও নীতিগত সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে। এসব রাজস্ব ও উৎপাদনশীলতা সংস্কারে জোট সরকারের হাতে খুব সময়ও নেই। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ীভাবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাঠামোগত পরিবর্তনে এই সরকারকেই হাত দিতে হবে। কাজেই নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা জনতুষ্টিমূলক পদক্ষেপ নেবে না বলেই আশা করা যায়।
এসএ/