ঋণের চাপে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা
প্রায় ৫১ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক ঋণ মাথায় নিয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। তারা বলেছে, ঋণদাতাদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সংকটে জর্জরিত দেশটি মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) এ ঘোষণা দিয়েছে।
গত দুই বছরে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭০ শতাংশ কমেছে, রিজার্ভে আছে মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার। ফলে খাদ্য, তেলসহ প্রয়োজনীয় আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটে লাখ লাখ শ্রীলঙ্কান চাকরি হারিয়েছে। পরিবারগুলোর আয় কমেছে। ফলে বেড়েছে দারিদ্র্য। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রতিদিন ৩.২ ডলারের কম আয় করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১১.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা তার আগের বছর ছিল ৯.২ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ।
এ অবস্থায় দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, একদিকে কোভিড-১৯ মহামারি, অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ ও তার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর ফলে বাধ্যতামূলক স্বাভাবিক সার্ভিসিং সেবা অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ব্যতিক্রমী সব পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যদি আরও বিলম্ব করা হয় তাহলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি স্থায়ীভাবে ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিঙ্গে বলেছেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা চ্যালেঞ্জিং ও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে উত্তম পন্থা হতে পারে ঋণ কাঠামো পুনর্গঠন ও কঠোরভাবে ঋণখেলাপি হওয়া এড়ানো। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সাময়িক স্থগিত ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এটা তাদের একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ।
এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে যে, সরকার কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। তারা তীব্র মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে লড়াই করছে। সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে জোর আন্দোলন। এতে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের এই দ্বীপরাষ্ট্রে মানবিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। দেশটি গৃহযুদ্ধের দিতে ধাবিত হচ্ছে বলে আগেই সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসরা বলেছেন, করোনা ভাইরাস সংকট সময়ের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যেতে পারেন এতে। এরই মধ্যে খাদ্যের দাম বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাচ্ছে লোকজন।
১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় শ্রীলঙ্কা। তারপর থেকে এবারই প্রথমবার তারা ঋণখেলাপি বা দেউলিয়া হওয়ার ঘোষণা দিল। দেশটি সম্প্রতি জ্বালানি, খাদ্য, মেডিকেল সরঞ্জামাদি আমদানিতে লড়াই করছে। কয়েক মাসে এসব খাতে সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সঙ্গে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নাড়া লেগেছে। প্রতিবাদে উত্তপ্ত শ্রীলঙ্কা। তাদের দাবি, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে হবে। তার পরিবার দুই দশক ধরে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে, তার ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপক্ষে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের সঙ্গে একটি বেইলআউট বা সংকট উত্তরণে অর্থায়ন বিষয়ক একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে সরকারের। এরই মধ্যে তীব্র জনরোষের ফলে মন্ত্রিপরিষদে রদবদল করেছে তারা। ২৪ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। রাজাপাকসের অর্থনৈতিক টিম বলেছে, তারা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ জন্য সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কান রুপির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা আশ্বস্ত হন যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ন্ত্রণে সময় দেওয়া হয়, তাহলে তারা প্রদেয় অর্থ পরিশোধে সক্ষম হবে। বর্তমানে সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ আছে। এই বছরে এর বিপরীতে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের কথা দাতাদের কাছে।
কলম্বোতে নিরপেক্ষ থিংকট্যাংক এডভোকেটা’র প্রধান মুর্তাজা জাফেরজি বলেন, দেশের অর্থনীতির অবনমন বা নিম্নমুখী হচ্ছে এ কথা বছরের পর বছর ধরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন রাজাপাকসে সরকার। ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, রাজাপাকসে বড় অঙ্কের ট্যাক্স কর্তন করেন। যখন অনেক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে তখন এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে করোনাভাইরাস মহামারিতে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় উবে গেছে। শ্রীলঙ্কার ডলারের রিজার্ভ যখন শুকিয়ে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি শক্ত কামড় বসিয়েছে, তখন জনগণের চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। কারণ, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। গ্যাস স্টেশনে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি অনেক কর্মকর্তা সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, দেশটিতে মানুষজন গণহারে অনাহারে থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মুর্তাজা জাফেরজি বলেন, আমাদের রিজার্ভ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত জনগণ ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন তারা ভয়াবহ এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি রাজাপক্ষে একটি অর্থনৈতিক টিম প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আক্ষরিক অর্থে সমস্যাকে আরও বড় করেছে।
গোতাবায়া রাজাপক্ষের ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষে এর আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে ৪ এপ্রিল তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন রাজাপক্ষে। তিনজন প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদকে তিন দিন পরে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা টিমে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি সম্প্রতি সুদের হার অনেক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। নিজের ভাইকে সরিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আলি সাবরিকে নিয়োগ দিয়েছেন রাজাপক্ষে।
ঋণ খেলাপি ঘোষণা দেওয়ার আগে আলি সাবরি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে, ভয়াবহ খাদ্য ও ওষুধের সংকটে পড়বে শ্রীলঙ্কা। এক্ষেত্রে সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলছে ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে। এই সংকটে জরুরি সরবরাহ দেয়া নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে সরকারের। আলি সাবরি আরও বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার সহ আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে সংলাপ চালানো হচ্ছে। তাদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে ঋণের অর্থ পরিশোধে সময় বাড়াতে। প্রস্তাব করা হচ্ছে খাদ্য ও ওষুধের সংকট আরও তীব্র হলে এক্ষেত্রে সহায়তা করতে।
এসএ/