ইমরান খানও পারলেন না
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলগুলোর উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব ডেপুটি স্পিকার খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে আপাতত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টিকে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনুরোধ করায় প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন।
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক। সেই হিসেবে আগামী তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে দেশটিতে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও সবাইকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে ইমরান খানও তাদের পূর্বসুরীদের মতোই তার মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই কোনও প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। কেউ খুন হয়েছেন, কেউ বিরোধী দলের অনাস্থার মুখে পড়ে পদ ছাড়তে হয়েছে।
স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। কিন্তু তিনি ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান লিয়াকত আলি খান। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন চার বছর ৬৩ দিন।
লিয়াকত আলি খানের পর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ অগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তখন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন চলছিল। আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম।
কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন এই নির্দেশ মানতে চাননি। ফলে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মালিক গোলাম। খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন এক বছর ১৮২ দিন।
নাজিমুদ্দিনের পর প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ আলী বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দু’বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে বিবাদ শুরু হয়। এর পরই বোগরাকে একপ্রকার পদত্যাগে বাধ্য করেন ইসকান্দার মির্জা।
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন তিনি। সংগঠনবিরোধী কাজকর্মের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জার চাপে পড়ে সোহরাওয়ার্দীকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দু’মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় জাতীয় পরিষদে। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী হন ফিরোজ খান নুন। তার শাসনকালের সময় ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়ে ফিরোজ খান নুন জনপ্রিয়তা পান। ফলে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা তাকেও গদিচ্যুত করেন ইসকান্দার।
অষ্টম পাক প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন মাত্র ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি নিজে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত নুরুল আমিন।
নুরুল আমিনের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে ভুট্টো তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মোহাম্মদ জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর পর প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ খান জুনেজো। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হক।
পাকিস্তানের একাদশ এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী-সহ রক্ষণশীল এবং ইসলামপন্থী শক্তি তার নতুন চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টা রোধ করছে। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে ইসহাক তাকে বরখাস্ত করেন।
১৯৯০ সালে দ্বাদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক পাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যুত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির ভুট্টো এবং নওয়াজ শরীফ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্তসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি তার সরকার ভেঙে দেন। নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দু’বছর ২৩৭ দিন। এর পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।
বেনজির এবং নওয়াজের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন মীর জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দু’বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই পদত্যাগ করেন তিনি। পদত্যাগের আগে জামিলি প্রায় ৩ ঘণ্টা তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়ে মোশারফের মতের সঙ্গে জামিলির মতের মিল না হওয়ায় তাকে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করা হয় দাবি করেন অনেকে।
ষষ্ঠদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন চৌধরী সুজাত হোসেন। তার শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এর পর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।
এর পর প্রধানমন্ত্রী হন শওকত আজিজ। জেনারেল মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান। তবে শওকতের আমলে পাকিস্তানের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মনে করা হয়।
শওকত আজিজের পর প্রধানমন্ত্রী হন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিই সব থেকে বেশি দিন বহাল ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পাক সুপ্রিম কোর্ট তার প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করে।
পাকিস্তানের ১৯তম প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনের সময়কালও এক বছর পার হয়নি। আশরাফ মোট ২৭৫ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে ২০১৩ সালে ২৪ মার্চ তিনি তার পদ ছাড়েন। তাকেও একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
এর পর ২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দু’বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ শরীফ। তবে তৃতীয় বারে চার বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে তাকে ১০ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেন।
নওয়াজের পর ৩০৩ দিনের জন্য ২১তম পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শহিদ খোকন আব্বাসী। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তার জোট সঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। পাকিস্তানের ধারা বজায় রেখে ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না।
আরইউ/এমএমএ/