ইলন মাস্ক: সময়ের আলোচিত মুখ
শৈশবে বই পড়তে ভালোবাসতেন। আইজাক আসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজের বই পড়ে উপলব্ধি করেন, সভ্যতার বিকাশে অন্ধকার যুগের সম্ভাবনা ও স্থায়িত্বকাল কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। মাত্র দশ বছর বয়সে কমোডর ভিআইসি-২০ কম্পিউটার নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি হয়ে গেলেন প্রোগ্রামার।
১২ বছর বয়সে বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে তৈরি করে ফেললেন ভিডিও গেম ‘ব্লাস্টার’। প্রযুক্তি জগতে পদার্পণের শুরুর দিকে নানা ব্যর্থতার মুখোমুখি হলেও তিনি এখন সময়ের আলোচিত মুখ। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির নাম ইলন মাস্ক। সম্প্রতি তাকে বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব বা ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছে মার্কিন সাময়িকী ‘টাইম’ ম্যাগাজিন। তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ২৮১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পরিবহনের ধারণা বদলে দিয়ে প্রযুক্তির নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন তিনি। ব্যাটারিচালিত গাড়ি, পাতাল পরিবহন আর পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন প্রযুক্তিখাতের এই পথপ্রদর্শক।
১৯৯৫ সালে ইলন মাস্ক তার ভাই কিম্বল এবং গ্রেগ কৌরি এঞ্জেল ওয়েব সফটওয়্যার সংস্থা জিপ-২ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংস্থাটি মানচিত্র, দিকনির্দেশনাসহ সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি ইন্টারনেট সিটি গাইড তৈরি করে তা বাজারজাত করে। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩০৭ মিলিয়ন ডলারে জিপ-২ কিনে নেয় কমপ্যাক।
ইলন মাস্ক এরপর প্রতিষ্ঠা করলেন পেপাল। অনলাইনে অর্থ আদান-প্রদান এবং কেনাকাটার বিল পরিশোধ করার জনপ্রিয় মাধ্যম পেপাল। ইলন মাস্ক হলেন পেপাল এর অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থায় রীতিমতো নেতৃত্ব দিচ্ছে পেপাল। বিশ্বের ২০০টির অধিক দেশে ৩৬০ মিলিয়নের বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে পেপালের।
২০০১ সালে মাস্ক মঙ্গল ওসিসকে কল্পনা করে মঙ্গল গ্রহে একটি ক্ষুদ্র গ্রিনহাউস তৈরির ধারণা দেন। যা ফসল বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করবে এবং মহাকাশ অনুসন্ধানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। মাস্ক ২০০২ সালের মে মাসে স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্পস (স্পেসএক্স) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনটি ব্যর্থ লঞ্চের পরে স্পেসএক্স ২০০৮ সালে ফ্যালকন ১ চালু করতে সফল হয়। এটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর প্রথম ব্যক্তিগত তরল-জ্বালানী রকেট ছিল।
প্রচলিত রকেট একবার মহাশূন্যে গিয়ে আর ফেরে না। এই ভাবনা থেকে মাস্ক ২০১৪ সালে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে। চারবারের চেষ্টায় মহাকাশে রকেট পাঠাতে সফল হয় স্পেসএক্স।
স্পেসএক্স পরে সফলভাব সমুদ্র-ভিত্তিক পুনরুদ্ধার প্ল্যাটফর্ম, স্বায়ত্তশাসিত স্পেসপোর্টের ড্রোন জাহাজে ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালে স্পেসএক্স ফ্যালকন হেভি চালু করে। ২০১৭ সালে স্পেসএক্স তার পরবর্তী প্রজন্মের প্রবর্তন গাড়ি এবং মহাকাশযান সিস্টেম, বিগ ফ্যালকন রকেট (বিএফআর) উন্মোচন করে।
২০১৮ সালে স্পেসএক্স একটি চন্দ্র টার্নিভিগেশন মিশন-২০২৩ ঘোষণা করে। যা একটি বেসরকারি বিমান। ২০২০ সালে স্পেসএক্স তার প্রথম চালিত ফ্লাইট ডেমো-২ চালু করে। এখন স্পেসএক্সের বাজারমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।
ইলন মাস্ক প্রতিষ্ঠা করলেন ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরির কোম্পানি টেসলা। ২০০৮ সালে রোডস্টার নামে একটি বৈদ্যুতিক স্পোর্টস গাড়ি তৈরি করেছিল এ কোম্পানি। এটি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি কোষ ব্যবহার করার জন্য প্রথম উৎপাদিত সর্ববৈদ্যুতিক গাড়ি। ২০২০ সালে সবচেয়ে মূল্যবান গাড়ি প্রস্তুতকারক হয়ে উঠেছে এ কোম্পানি। টেসলা এখনকার বাজারে অন্যতম এক ব্র্যান্ড। কোম্পানির বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
মাস্ক ২০০৮ সালে সিইও এবং পণ্য স্থপতি হিসেবে সংস্থার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ইলন মাস্ক বিশ্বে মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী সিইও।
এ ছাড়া ইলন মাস্ক সোলারসিটির চেয়ারম্যান ও দি বোরিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। নিউরোটেকনোলজি স্টার্টআপ সংস্থা নিউরালিংকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও সফলতার দৃষ্টান্ত রাখেন তিনি।
ইলন রিভ মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে ১৯৭১ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার মা মেই মাস্ক একজন মডেল এবং ডায়েটিশিয়ান। তিনি কানাডার সাসকাচোয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বড় হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। ইলন মাস্কের বাবা হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন তড়িৎ প্রকৌশলী, বৈমানিক, নাবিক, পরামর্শক এবং সম্পত্তি বিকাশকারী। তার একটি ছোট ভাই কিম্বল এবং একটি ছোট বোন টসকা আছে। তার নানা জশুয়া হাল্ডম্যান একজন আমেরিকান বংশদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক। তার দাদি ব্রিটিশ এবং পেনসিলভেনিয়া ডাচ বংশদ্ভুত।
১৯৮০ সালে তার বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর মাস্ক বেশিরভাগ সময় তার পিতার সঙ্গে প্রিটোরিয়া শহরে থাকতেন। বিবাহ বিচ্ছেদের দুই বছর পরে তিনি বাবার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের জন্য আফসোসও করেছিলেন মাস্ক।
কানাডা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা সহজতর হবে জেনে মাস্ক কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত মায়ের মাধ্যমে কানাডার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। ভিসা প্রাপ্তির কাগজপত্রের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তিনি ছয় মাস প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। যার ফলে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এড়াতে পেরেছিলেন।
১৯৮৯ সালের জুন মাসে কানাডায় আসার পর মন্ট্রিয়লে তার দাদার ভাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি তরুণদের জন্য নির্মিত একটি হোস্টেলে থাকতেন। এরপর তিনি সাসকাচোয়ানের পশ্চিমে তার এক খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে চলে যান। তিনি এক বছর সেখানে থাকা অবস্থায় একটি খামারে ও কাঠের কারখানায় কাজ করতেন।
১৯৯০ সালে মাস্ক কানাডার অন্টারিও রাজ্যের কিংস্টন শহরের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দুই বছর পর তিনি পেন্সিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হন। ১৯৯৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে অর্থনীতিতে ও ইউপ্যান স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স হতে পদার্থ বিজ্ঞানের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় কানাডিয়ান লেখক জাস্টিন উইলসনের সঙ্গে দেখা হয় মাস্কের। তারা ২০০০ সালে বিয়ে করে এবং ২০০৮ সালে পৃথক হয়। তাদের প্রথম ছেলে নেভাদা আলেকজান্ডার মাস্ক। ১০ সপ্তাহ বয়সে আকস্মিক শিশু মৃত্যুর সিন্ড্রোমে (এসআইডিএস) মারা যায় তার প্রথম সন্তান।
২০০৮ সালে মাস্ক ইংরেজ অভিনেত্রী তালুলাহ রিলের সঙ্গে দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়ান। ২০১০ সালে এই দম্পতি বিয়ে করেন। ২০১২ সালে মাস্ক ও রিলে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেয়। ২০১৩ সালে তারা পুনরায় বিয়ে করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মাস্ক দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন। তবে পদক্ষেপটি প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৬ সালে তার দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়।
অ্যাম্বার হিয়ার্ডের সঙ্গে ২০১২ সালে সাক্ষাৎ হয় মাস্কের। ২০১৭ সালে জনি ডেপের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর মাস্কের বিরুদ্ধে হিয়ার্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।
২০১৮ সালের মে মাসে মাস্ক এবং কানাডিয়ান সংগীতশিল্পী গ্রিমস প্রকাশ করেছেন যে, তারা সম্পর্কে জড়িয়েছেন। গ্রিমস ২০২০ সালের মে মাসে তাদের পুত্রের জন্ম দেন।
২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকে ২০২০ সালের শেষের দিক পর্যন্ত মাস্ক ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস অঞ্চলে বাস করতেন। যেখানে টেসলা এবং স্পেসএক্স উভয়ই প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেখানে তাদের সদরদপ্তর এখনও রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে মাস্ক টেক্সাসে বসবাস করছেন।
টিটি/এসএ/