ইউক্রেনে একমত, আমেরিকায় বিভক্ত বিশ্ব
যদি ধরে নেই যে ঠান্ডা লড়াই চলছে তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এ যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পরপরই এক সংবাদ সম্মেলন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ কথা বলেন। তবে আগ্রাসন শুরু কয়েক দিন পর রাশিয়া বিরোধী নিন্দা একটু কমতে শুরু করে, বিশেষ করে ভারত ও চীন রাশিয়ার এ হামলার বিষয়ে তীব্র কোন প্রতিক্রিয়া জানয়নি। এমনকি আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মিশর থেকেও কোন নিন্দা বা প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ব্রাজিলের অবস্থান ছিল নড়বড়ে। পরে মার্কিন চাপের মুখে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ব্রাজিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ জন এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তাই ব্রাজিলের আর কোনও উপায়ও ছিল না। জাতিসংঘ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক নিন্দা জানানোর পর রাশিয়াকে সহিংসতা বন্ধ করে আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তবে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করে একত্রে আওয়াজ তোলা থেকে সরে গেল অনেকেই।
এর পরই প্রশ্ন উঠলো রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করার পরও অর্থনৈতিক ও কৌশলভাবে পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা এক হওয়ার পরও কেন ইউক্রেন ইস্যুতে দ্ব্যার্থহীনভাবে এক হতে পারলো না? খুব ছোট করে যদি এর উত্তর খুঁজি, তাহলে বলা যায়-ইউক্রেন রাশিয়া সংঘাতের ইউক্রেন নয় আমেরিকার স্বার্থের পাল্লা বেশি ভারী। এটাই মূল কারণ। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা তার একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তার করে চললেও গত কয়েক বছর চীন ও রাশিয়ার শক্তির কাছে একটু হলেও কাবু হতে হয়েছে। আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্রগুলো বা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো আমেরিকা-রাশিয়ার আরেকটি ঠান্ডা যুদ্ধের মুখোমুখি হতে চায় না। আর রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে ইউক্রেন দুর্দশার শিকার হলেও আমেরিকা কিন্তু নির্দেষ নয়।
স্বঘোষিত 'বিশ্ব পুলিশ' এর দায়িত্ব পালন করা আমেরিকা রাশিয়া ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে বিভিন্ন অজুহাতে নাক গলায়। এছাড়া আগ্রাসন, দখলদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থানও দ্বিচারী। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হলে আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলোর জন্য এক ধরনের নীতির আশ্রয় নেয়, যা থাকে অন্যদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান।
আমেরিকা রাশিয়া যুদ্ধ বাধলে পরিস্থিতি অনেক বেশি উত্তপ্ত হবে এটা না বুঝতে পারার কোন কারণ নেই। কারণ মস্কো ও ওয়াসিংটন নিজ নিজ স্বার্থকে অক্ষন্ন রাখতে মরিয়া হয়ে উঠবে ফলে এর মূল্য দিতে হবে অপরিমেয়। বিশ্ব ভাগ হবে উত্তর ও দক্ষিণে। শুধু তাই নয়, শুরু হবে দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ যার একদিকে থাকবে চীন ও রাশিয়া। আরেক দিকে থাকবে ওয়াসিংটন ও ন্যাটো। যুদ্ধ যদি বাধেই, তার ভয়াবহতা হতে পারে অকল্পনীয়। কারণ বর্তমান বিশ্বের দেশগুলো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ও সংযুক্ত। তাই এই ঠান্ডা শুরু হলে শুধু আমেরিকা বা রাশিয়া নয় প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্বে। তাছাড়া মানবিক বিপর্যের কথা ভাবলে যুদ্ধ থেকে সরে আসাই হবে কল্যাণের এমনটাই ভাবছে অনেক রাষ্ট্র এমনকি আমেরিকার মিত্রদের ভাবনাও এর বাইরে নয়। তাই অর্থনৈতিক ও কৌশলভাবে পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা এই যুদ্ধে এক হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধতা করতে পারেনি।
১৯৮০ এর দশকের স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে, বেশিরভাগ রাষ্ট্র নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বাড়াতে মন দিয়েছে। তারা রাশিয়া বা আমেরিকা, চীন বা ই্ইউ এককভাবে কোন এক পক্ষ বেছে নিতে রাজী নন। আর এ যুদ্ধে না জড়ানোর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও অনেকটা ভূমিকা রাখছে। ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে রাশিয়া, চীন বা আমেরিকা কোন পরাশক্তির বিরুদ্ধেই যেতে চাইছে না অনেক রাষ্ট্র।
গত কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দেশগুলোকে তার ছত্রছায়ায় রেখেছে তাদেরকে নিজের সংকটে কাজে লাগাচ্ছে, ফলে অনেক সময় অনেক দেশকে এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হয়। ৯/১১ এর হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডর্জ ডাব্লিউ 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধের' ঘোষণা দিয়েছিলে। এ সময় তিনি বলেন 'আপনি হয় আমাদের সাথে বা আমাদের বিপক্ষে' এর মাঝামাঝি আর কোনো পথ নেই। অর্থাৎ যারাই আমেরিকার সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরোধী যুদ্ধে অংশ নেবে না তারাই আমেরিকার শত্রু। এ সব পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশিভাগ দেশই আর যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। আবার আমেরিকার শত্রু হতেও চাইছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরান, ইরাক এবং উত্তর কোরিয়াকে কালো তালিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার পর ইরাকে আক্রমণ চালায়। আমেরিকার স্বার্থ রক্ষায় মিত্রদেশগুলোকে কাজে লাগায়। পরের কয়েক দশকে আমেরিকা তার বিরুদ্ধে যাওয়া দেশগুলোকে কোণঠসা করতে পিছুপা হয়নি। আন্তর্জাতিক বানিজ্যে চীনের প্রশার রোধে আমেরিকা তার বানিজ্যের অংশিদারদের কাজে লাগিয়েছে। এমনকি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘে পেশা করা আমেরিকার প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা গিয়েছিলো সেই সকল রাষ্ট্রের নাম ধরে, তাদেরকে হুঁশিয়ারি দিতে পিছপা হয়নি ট্রাম্প প্রশাসন।
আমেরিকা যখন পিছিয়ে পড়ছে চীনের অর্থনীতিকর কাছে, সেই সুযোগে রাশিয়া আগের মতো শক্তি বৃদ্ধির পথে হাঁটছে, ঠিক তখন আমেরিকা মরিয়া নিজের বিশ্ব মোড়লের পদটা ঠিক রাখতে। আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় আমেরিকা, ইরাকে পরাজয় সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়ায় আমেরিকার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনকে রাশিয়ান সামরিক শক্তির সামনে এভাবে ছেড়ে দেওয়ায় আমেরিকার ওপর বিশ্বাস উঠে গেছে বিশ্বের অনেক দেশের। গত কয়েক দশকে আমেরিকা তার বিশ্বস্তা হারিয়েছে। স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো আমেরিকার মুখোশ গেছে খুলে।
যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু হয়, তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজ দেশের নাগরীককে আশ্বস্ত করেন যে, এ যুদ্ধের ফলে তার দেশের নাগরীককে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না। এ প্রেক্ষিতে একজন এক বিশ্লেষণ বিদ্রূপের সাথে মন্তব্য করেছেন, 'ইউক্রেনের শেষ সৈন্য থাকা পর্যন্ত, আমেরিকা রাশিয়ার সাথে নড়বে।'
আমেরিকা-রাশিয়া যদি এবার স্নায়ু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তবে বিশ্ব মহামরি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে পিছিয়ে পড়বে। দারিদ্র ও রোগ মোকাবেলায় বৈশ্বিক সহযোগীতা থেকে সরে আসতে হবে। শুরু হবে অস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রের শোডাউন। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ বাধবে। যার ফলে ভয়ানক মানবিক দুর্ভোগ, অর্থনৈতিক পতন এবং অকল্পনীয় পরিণতিসহ বিশ্ব হয়ে উঠবে একটি সংঘাত ভূমি।
কেএফ/