যুক্তরাজ্যে রাশিয়ানদের অবৈধ বিনিয়োগ
ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে কথা বিবেচনা করছে। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাজ্যে রাশিয়ার বিনিয়োগ। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বিবিসিকে বলেন,'অতীতে লন্ডনে অবৈধ অর্থায়ন ছিল, আমরা সেগুলো চিহ্নত করছি এবং অবৈধ বিনিয়োগের পথ বন্ধ করছি।' এ সমস্যার মোকাবেলা করা কী কঠিন এ প্রশ্নই করেছেন তিনি।
রাশিয়া এবং সারা বিশ্বের অনেক ধনী ব্যক্তি এবং কোম্পানি যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাত ও সম্পত্তিতে বৈধভাবে বিনিয়োগ করে থাকেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাজ্যে পাঁচ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ চিহ্নিত করেছে, যেটাকে 'সন্দেহজনক সম্পদ' বলছে সংস্থাটি। আর ওই বিনিয়োগের এক-পঞ্চমাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে।
ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগের সন্ধান যুক্তরাজ্যে পেয়েছে। ওই সকল বিনিয়োগ মূলত বিলাসবহুল সম্পত্তি, গাড়ি, স্কুল ফি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান হিসাবে ব্যয় করা হয়।
আর সম্পত্তিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নামে নয় কোম্পানির নামে বিনিয়োগ করতে দেখা যায়। ফলে বেশিভাগ সময় ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ে। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের ওভারসিজ কোম্পানির মালিকানা সংক্রান্ত ডাটাবেস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগে যে ৯৪ হাজার সম্পত্তি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৪টিতে রাশিয়ার বিনিয়োগ চিহ্নিত হয়েছে। ওই চারটি কোম্পানির বৈধ রেজিস্ট্রেশন আছে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন রাশিয়ানদের বিনিয়োগ আরও বেশি হবার সম্ভবনা রয়েছে। কারণ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মতো জায়গায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ অনেক বেশি। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্যান্ডোরা পেপারসের ১২ মিলিয়ন নথি প্রকাশ হবার পর জানা গেছে, মোনাকোতে গোপন সম্পদ আছে পুতিনের। সেসময় বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান অন্তত ৩৫ জন নেতা ও ৩০০-র বেশি সরকারি কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে প্যান্ডোরা পেপারসে।
প্যান্ডোরা পেপারসকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির নথিগুলোর একটি। পানামা, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশ এবং অঞ্চলের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালীরা যে অর্থ রেখেছেন ও গোপন লেনদেন করেছেন সেই তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারসে। গবেষকরা ৭০০ টিরও বেশি অফশোর কোম্পানি শনাক্ত করেছে যেগুলোর ইংল্যান্ডে সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে, এদের মধ্যে পাঁচ শতাংশই রাশিয়ান নাগরিকদের মালিকানাধীন।
উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আলেক্সি চেপার কথা বলা যেতে পারে যিনি ২০১১ সালে হল্যান্ড পার্কে একটি ১০ বেডরুমের প্রাসাদ কিনতে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের একটি কোম্পানির নাম ব্যবহার করেছিলেন। ওই সম্পত্তিটি গত বছর তিনি ২৫ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রিও করেছেন। আলেক্সি চেপার প্রতিনিধি জানান, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে বৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।
যু্ক্তরাজ্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গোল্ডেন ভিসা দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে দুই মিলিয় বা তার বেশি বিনিয়োগকারীদের স্থায়ী আভিবাসন দেওয়া হয় এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের পরিবারসহ থাকার সুযোগ পান।
তবে ইউক্রেন সঙ্কেটের জেরে রাশিয়া-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক নিয়ে চাপের মধ্যে সরকার শীঘ্রই এই স্কিমটি বাতিল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে গোল্ডেন ভিসাধারীরা পরিবারের সাথে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবেন। তারা কত দ্রুত আবেদন করতে পারবেন তা নির্ভর করবে তাদের বিনিয়োগের ওপর।
২০০৮ সালে এই স্কিমটি চালু হওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুই হাজার ৫৮১জন রাশিয়ান নাগরিককে বিনিয়োগকারী ভিসা দিয়েছে। আর বিদেশি অবৈধ বিনিয়োগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাজ্য সরকার ২০১৮ সালে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কোনো প্রকার কারণ না দেখিয়েই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া চালু করে। আরেকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটি হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ। অবৈধভাবে বিনিয়োগ হয়েছে এমন সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য সরকার ঘোষণ দেয় যে, মানি লন্ডারিং এর বিরুদ্ধে লড়তে বৈধ রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দেবে। ২০১৯ সালে রানি এলিজেবেথ বৈধ রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করার পরিকল্পনা করছে, তবে সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এমনি ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ আইন প্রণয়নের কথা ভাবলেও ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত পাল্টান।
রাশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে কী সিন্ধান্ত নেবে যুক্তরাজ্য এমন প্রশ্নের মুখেই, রাশিয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরও জোরালো করার ঘোষণা এল দেশটির পক্ষ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বা সম্পদ জব্দ করার মতো বিষয়গুলো ভাবছে সরকার। আর আমেরিকার মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবে তার দেশ। ক্রেমলিনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যের সম্পদ ফ্রিজ করা হবে, যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে এবং তারা যুক্তরাজ্যের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যবসা করতেও পারবে না।
কেএফ/জেডএকে/