ম্যাডের সেরা কার্টুনিস্ট আল জাফি
আল জাফিকে ‘ম্যাড’ ম্যাগাজিন খুঁজলেই পাওয়া যাবে। তবে তিনি আর এই জগতে নেই। চলে গিয়েছেন ১০ এপ্রিল ২০২৩। বেঁচে আছেন তার ম্যাডের কার্টুন ও ইলাসট্রেশনগুলোর মধ্যে। পুরো নামটি তার অ্যালান জাফি। তবে বাবা-মা নামটি রেখেছেন ছেলের আব্রাহাম জাফি। মাকিন এই প্রখ্যাত কাটুনিস্ট জন্মেছেন ১৯২১ সালের ১৩ মার্চ।
ম্যাডে তার ট্রেডমার্ক ফিচার ছিল ‘দ্যা ম্যাড ফোল্ড-ইন’। টানা ৬৫ বছর ম্যাডে কাজ করেছেন। তাদের সবচেয়ে বেশি বছরের কার্টুনিস্ট ছিলেন। ১৯৪২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। ফলে একজন কমিক আর্টিস্ট হিসেবে বিশ্বরেকডেরও মালিক হয়েছেন তিনি। নিজে বলেছেন, ‘আমার বয়সের সিরিয়াস মানুষরা সবাই মারা গিয়েছেন।’ ম্যাডে তার আরেকটি রেকর্ড হলো ১৯৬৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই ব্যঙ্গ ও হাস্যরসাত্মক ম্যাগাজিনের কোনো সংখ্যাই জাফির নতুন কাজ ছাড়া ছাপা হয়নি। তাকে বিবেচনা করা হয় নিজের সময়ের সবচেয়ে বড় কাটুনিস্টদের একজন হিসেবে। সবাই জানতেন যে, তিনি যে কোনো কিছুকে কার্টুন বানিয়ে ফেলতে পারেন।
জন্মেছেন জর্জিয়াতে। বাবা-মায়ের চার ছেলের সবার বড় ছিলেন। তারা ইহুদি। লিথুয়ানিয়া থেকে দেশটির উপকূলীয় শহর সাবানাহতে অভিবাসন করেছেন। একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার ছিলেন বাবা। তারা একসময় চলে এলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন আল জাফির বয়স মোটে ৮। তিনি পড়ালেখা করেছেন নিউইয়র্ক সিটির হাইস্কুল অব মিউজিক অ্যান্ড আর্টে, ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে। সহপাঠী ছিলেন তার ভাই হ্যারি, ম্যাডের ইলাসট্রেটর ও কাটুনিস্ট উইল এডলার, ম্যাডের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কিন কাটুনিস্ট হার্ভি কার্টজম্যান, মার্ভেলের কমিক শিল্পী জন স্যাভেরিন ও ইসি কমিকস ও ম্যাডের আল ফ্যাল্ডস্টাইন।
আল জাফির পেশাজীবনের শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে। তিনি জোকার কমিকসে সে বছরের ডিসেম্বরে তার প্রথম কার্টুন প্রকাশ করলেন। পাশাপাশি টাইমলি কমিকস ও অ্যাটলাস কমিকসে কাজ করেছেন ১৯৪০ ও ১৯৫০’র দশকে। মার্ভেল কমিকসেও কাজ করেছেন। ম্যাডে ডেভ বার্গের সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। টাইমলির জন্য তখন বিখ্যাত কাজ করেছেন ‘ইনফেরিয়র ম্যান’ নামের চরিত্র। তিনি কার্টুন লেখকদের বাক্যগুলোর ওপর কার্টুন করতেন বলে অবলীলায় জানিয়েছেন। আরো বলেছেন, ‘আমি কে যে সম্ভাবনাময় চাকরিদাতাদের সঙ্গে তক করবে?’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন। রাস্ক ইনস্টিটিউট অব রিহ্যাবিলিটিস মেডিসিনের নকশাটি তার করা। পেন্টাগনে কাজ করার সময় তার সঙ্গে দেখা হলো রুথ আলকুইস্টের সঙ্গে। ১৯৪৫ সালে তারা বিয়ে করলেন। পরের বছর সাধারণের জীবনে ফিরে এলেন আল জাফি। কাজ শুরু করলেন স্ট্যান লি’র সঙ্গে। দেড় বছর তিনি টাইমলির হিউমার ও টিনেজ কমিকসগুলো সম্পাদনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হলো ‘পাস্টি ওয়ার্কার’।
বিখ্যাত চরিত্র ‘জিগি পিগ’ ও ‘সিলি সিল’ তার তৈরি। কীভাবে শুরু? “প্রধান সম্পাদক স্ট্যান লি আমাকে বলেছিলেন, ‘অ্যানিমেটেড ধরনের একটি চরিত্র তৈরি করো যেটি কিছুটা ভিন্ন ও কিছুটা নতুন হবে।’ আমি চারপাশে অনেক খুঁজলাম ও ভাবলাম। সিল মাছ নিয়ে কাউকে কিছু করতে দেখিনি। ফলে তাকে প্রধান চরিত্র হিসেবে তৈরি করলাম। এভাবেই তৈরি হলো সিলি সিল’। আরেকদিন স্ট্যান লি আমাকে বললেন, ‘তাকে ছোট কোনো বন্ধু কেন দিচ্ছ না?’ আগেই আমি ‘জিগি পিগ’ বানিয়েছিলাম, সে হলো একটি ছোট শুকরছানা। ফলে তাদের দুজনকে একটি সিরিজে দ্রæত নিয়ে এলাম। কাজটি খুব সহজ হলো। তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে’।”
১৯৫৭ থেকে ৬৩ টানা ছয়টি বছর জাফি কাজ করেছেন নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউনে, সেখানে তিনি ‘টল টেলস’ প্যানেলে কাজ করেছেন ও ১শটির বেশি দৈনিকের সিন্ডিকেটে তার কাজগুলো ছাপা হয়েছে। এগুলো নির্বাক কাটুন ছিল। এত দারুণ ছিল যে, যখন তারা এখানে কথা যোগ করলেন, বিদেশী ২৮টি পত্রিকা ছুটে গেল। ২০০৮ সালে তার টল টেলস স্ট্রিপগুলোর একটি কালেকশন প্রকাশিত হয়েছে। ইহুদি শিশুদের জন্য প্রকাশনা সিভস হিশেমের জন্য ১৯৮৪ সাল থেকে হালকা অভিযানের কহিনী নিয়ে ইহুদিদের ধর্ম ও জীবনযাপনের ভিত্তিতে ‘দি সিপ্পি’ নামের ইলাসট্রেশন শুরু করেছেন। শিশুতোষ দ্বিমাসিক প্রকাশনা দি মেশিয়েক টাইমসে ছাপা হয়েছে।
ম্যডে তিনি পুরোপুরি কাজ শুরু করেছেন ১৯৫৫ সালে। কমিক বুক থেকে তারা ম্যাগাজিনে চলে আসার পর। আগে প্রকাশক ও তার সহপাঠী হার্ভি কার্টজম্যান তিনটি সংখ্যা করেছেন, চতুথ সংখ্যা থেকে আল জাভি। তিনি এর আগে কার্টজম্যানের দুটি হাসির ম্যাগাজিন হামবার্গ (১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮) ও ট্র্যাম্প (গøসি, বিদ্রæপ ও হাসির ম্যাগাজিন; মোটে দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৭ সালে)-এ কাজ করেছেন। তবে ম্যাড হাভি কার্টজম্যানের ভাগ্য ফিরিয়ে দিলো চিরকালের মতো। ২০০৮ সালে তারা হামবার্গের পুরো রিপ্রিন্ট করেছেন, দুটি ভলিউমের একটি সেট। ১৯৫৮ সালে হামবার্গ বন্ধ হয়ে গেল ও নিজের ছাপা না হওয়া জিনিশগুলো ম্যাডে নিয়ে এলেন আল জাফি। ১৯৬৪ সালে ৮৬তম প্রথম নিজের ফোল্ড-ইন হিসেবে খ্যাত ফিচারটি প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকে ম্যাডের সবচেয়ে দীর্ঘকালের ফিচার আইটেম হয়ে গেল এটিই। ফোল্ডারের ভেতরের এই ফিচারের প্রতিটি সংখ্যায় তিনি লুকিয়ে দিতেন ছবি ও নতুন ক্যাপশন। একটি নতুন ইংরেজি ভাষার বিশ্ব তৈরি করলেন তিনি। ম্যাডের পরিচয়বাহী কাজ হলো তার এই কর্ম। কেবল ১৯৭৭ সালের একটি সংখ্যা তার এই ফিচার ছাড়া ছাপা হয়েছে। যদিও সেই সংখ্যার পেছনের কাভারটি করেছেন। ম্যাডে তার এই বিভাগ ১৯৬৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত একটানা চলেছে। এলিজাবেথ টেইলর, রিচাড নিক্সন, বিটলস কাকে নিয়ে কাজ করেননি? শেষ কাজ করেছেন ২০২০ সালের আগষ্ট সংখ্যায়।
আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাডের চাকরি ছাড়লেন ১৯৯৯ সালে, অবসরের মাধ্যমে। সেবারই ছাপা হলো ‘আল জাফি ট্রিবিউট ইস্যু’ বা আল জাফি শ্রদ্ধাঞ্জলী সংখ্যা। ম্যাডে তার তৈরি ফোল্ডার-ইন এখনো চলছে, খুবই জনপ্রিয় বরাবরের মতো। কখনোই তিনি ছাপা হওয়ার আগে তার শেষ করা কাটুন দেখতেন না। কেমন করেছেন ও কেমন করতে পারতেন, সেই বিচার এভাবেই করতেন। তাকে ম্যাড বিবেচনা করতো, ‘কম্পিউটারের বিপরীতে কর্মী’। এই ম্যাগাজিনের সবচেয়ে পুরোনো ও নিয়মিত কমী আল জাফি ৫৫০টি সংখ্যার ৫শটিতেই কাজ করেছেন। যেকোনো কর্মীর চেয়ে অনেক বেশি। নিজে বলেছেন, ‘আমি এমন একটি ম্যাগাজিনে কাজ করেছি যেটি কিশোর, তরুণদের জন্য প্রয়োজনীয়। তাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজেকে চলমান রেখেছি। নিজেকেও খুব সৌভাগ্যবান মনে করছি। যখন বুড়ো অন্য ঘোড়াগুলো দৌড়াচ্ছে, আমিও দৌড়াতে চেয়েছি।’ এনওয়াই ১ নামের মার্কিন টিভি চ্যানেল তার কর্মজীবনের ওপর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। তার বিখ্যাত ফোল্ডার-ইন নিয়ে ‘দ্যা ম্যাড ফোল্ডার-ইন কালেকশন ১৯৬৪-২০১০’ চার ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০২০ সালের জুনে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা দিলেন ও তার ম্যাড সে মাসেই তাকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাটি করলো। তিনি একশর বেশি ফিচার লিখেছেন এখানে।
তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার কার্টুনিষ্টদের সংগঠনে তার ফোল্ড-ইনের জন্যই প্রথম ‘দ্যা ন্যাশনাল কাটুনিস্ট সোসাইটি’র ‘স্পেশাল ফিচার রুবেন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করলেন ১৯৭১ সালে। ‘বিজ্ঞাপন ও ইলাসট্রেশন অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছেন ১৯৭৩ সালে। ‘স্পেশাল ফিচারস অ্যাওয়ার্ড ১৯৭৫ সালেও পেয়েছেন। ১৯৭৯ সালে জয় করেছেন ‘হিউমার কমিক বুক অ্যাওয়ার্ড’। ২০০৮ সালে আল জাফি লাভ করেছেন আবার রুবেন অ্যাওয়াড, বছরের সেরা কাটুনিস্ট হিসেবে। তার ফোল্ড-ইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মোশন থিওরি ‘গার্ল’ নামের একটি ভিডিও গান তৈরি করেছে। এখানে তার নামটিও আছে। দেখানো হয়েছে টিভিতে।
তার ও রুথ অ্যালকুইস্টের ঘরে দুটি ছেলে, মেয়ে আছে। রিচার্ড ও ডেবি। তবে এই দম্পতি ১৯৬৭ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়েছেন। তারপর থেকে ম্যাডের স্টুডিওতে আলাদা জায়গায় থাকতেন আল জাফি। ১৯৭৭ সালে তিনি আবার বিয়ে করেছেন একজন বিধবা নারী জয়েস রিভেনসনকে। এরপর আর বিয়ে ভাঙেনি আল জাফির। তার স্ত্রী ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মারা গিয়েছেন। তারা ম্যানহাটনে থাকতেন। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল ১০২ বছর বয়সে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ায় যখন বিশ্বের অন্যতম সেরা কার্টুন শিল্পী আল জাফি মারা গেলেন একটি হাসপাতালে তার চরিত্রগুলোও কাঁদলো।
ডিএসএস/