আইসক্রিমের ব্যবসায়ী ছোটবেলার দুই বন্ধু
তারা দুজনে, কোম্পানির নাম হলো তাদের “বেন অ্যান্ড জেরি’স হোমমেইড হোল্ডিংস ইনক”। তবে সবাই চেনেন “বেন অ্যান্ড জেরি’স” নামে। একটি মার্কিন কোম্পানি যেটি আইসক্রিম, ফ্রোজেন ইয়োগার্ট ও স্টোরবেট তৈরি করে। ১৯৭৮ সালে ভেরমন্টের বুরলিংটনে প্রতিষ্ঠানটির শুরু করেছেন দুই বন্ধু মিলে। একটি মোটে আইসক্রিম দিয়ে শুরু এবং ধীরে, ধীরে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করেছেন।
এখন তাদের সদর দপ্তর হলো সাউথ বুরলিংটনে। আর মূল কারখানা আছে ওয়াটারবুরিতে। আসল স্বাদ ও গন্ধের জন্য বিখ্যাত তাদের শিশুদের পণ্যগুলো। অনেক ধরনের খাবার মেশান তারা, ডেজার্টগুলো থাকে আইসক্রিমগুলোতে। জাদুকর, কৌতুকাভিনেতা, জনগনের প্রিয় মানুষদেরও তারা আইসক্রিমের মোড়কে এনেছেন। যেমন গ্রেটফুল ডেডের প্রধান গায়ক, গীতিকার জেরি গার্সিয়া, বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা স্টিফেন কোলবার্টের নামে তাদের আইসক্রিম আছে। তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যও আন্দোলন করেন। এভাবেই তাদের পণ্যগুলো তৈরি করেন, বিক্রি করেন ও বিপনন করেন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তারা বছরে ২০০ মিলিয়ন পিস আইসক্রিম বিক্রি করেন। বিশ্বের ৩৬টি দেশে যায় “বেন অ্যান্ড জেরি’স” পণ্যগুলো। তারা আইসক্রিম ব্যবসার বিশ্বের অন্যতম মাস্টার হিসেবে খ্যাতিমান।
তবে শিশুদের মতোই তাদের আজীবনের বন্ধুত্বটি তৈরি হয়েছে। সত্যিকারের বন্ধুত্ব কেমন তার উদাহরণ দুজনে। যখন তারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, একটি ব্যায়ামের ক্লাসে প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে গড়ে উঠেছে এই সম্পর্ক। দুজনেই ছিলেন ক্লাসের সবচেয়ে মোটা দুটি শিশু। তারপর একই কলেজে বন্ধু হিসেবে পড়েছেন দুজনে। বেনের পুরো নাম হলো বেন কোহেন আর জেরির জেরি গ্রিনফিল্ড। জেরি ওবারলিন কলেজে পড়ালেখা করছেন আর বেন কলেজে তেমন পড়তে পারেননি। কদিন পরেই তার নামটি অনিয়মিত হিসেবে কাটা পড়লো। এরপর কদিন মাটির জিনিশপত্র বিক্রি করলেন। তবে সেখানে সফল হতে পারলেন না। এরপর আবার দুই বন্ধু মিলে তাদের দুজনের ব্যবসা শুরু করতে নিউইয়র্কে চলে গেলেন। নতুন ব্যবসার জন্য তাদের পুঁজি হলো মোটে ৮ হাজার মার্কিন ডলার। মাছের খাবার, আইসক্রিমের কেস, পত্রিকা বিক্রি করেছেন শুরুতে। এরপর দোকানের চারপাশে খাবার সাজিয়ে রেখে বিক্রি করা যাবে এমন একটি বুদ্ধি নিয়ে নামলেন। এরপরই তারা আইসক্রিম ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করলেন। তবে কীভাবে আইসক্রিম বানাতে হবে সেটি তো জানেন না দুই খাদ্যরসিক বন্ধু। ফলে ১৯৭৭ সালে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কীভাবে আইসক্রিম বানাতে হবে সেই কোসটিতে ভর্তি হয়ে গেলেন। ‘দ্যা স্মল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’র ছোট, ছোট বইগুলো পড়ে ব্যবসায়িক দক্ষতাগুলোও শেখা হলো তাদের। নিজেদের পাঠ্যপুস্তক ‘আইসক্রিম’টি খুব ভালোভাবে পড়ে ফেললেন ও সাথে রাখলেন দুজনে।
যখন শুরু করলেন, তখন এই তরুণ দুই উদ্যোক্তাকে সপ্তাহের সাতটি দিনই খুব খাটতে হতো। গড়ে ১০ ঘন্টা করে শ্রম দিতেন। এই শ্রমটি সফল হলো তাদের প্রথম দোকানটি খুলতে পারার মাধ্যমে। সেটি পেলেন তারা একটি রূপান্তরিত গ্যাস স্টেশনে তাদের বুরলিংটনের ভারমিংটনে। সেটি চালাতে লাগলেন। এখানেই জন্ম নিলো “বেন অ্যান্ড জেরি’স”। তবে বেন তাদের কোম্পানিটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন “জোসেফাইন’স ফ্লাইং মেশিন”। তবে তাতে রাজি হননি জেরি। আশ্চযের ব্যাপার হলো, ১৯৭৮ সালের ৫ মে, আজ থেকে ৪৪ বছর আগে যে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছেন তারা, তার সুদীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র একবারই নিজেদের বন্ধুত্ব ও ব্যবসায় জীবনে যুদ্ধে নেমেছেন পরস্পরের সঙ্গে। সেটি হলো, বেন চেয়েছিলেন যেন বড় আকারের পনির আইসক্রিমে দেন ও বিক্রি করেন তারা। বেনের স্বত:সিদ্ধ ধারণা ছিল যে, তাদের ক্রেতাদের সবাই সব আকারেরই চান। তবে জেরি তখন আইসক্রিম তৈরি করতেন। তার মনে হলো, বড় আকারের পনির তৈরি করা আইসক্রিম বানানোর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। তিনি আবার ফ্লেভারের দিকে খুব বেশি মনোযোগী বরাবরই। বেনের মনোযোগ তখন থেকে উৎকর্ষতার দিকে। পনিরের আকার নিয়ে এই জুটির কয়েক সপ্তাহ ধরে আলাপ আলোচনা ও ঝগড়া চলেছে। অবশেষে ক্রেতারাই তাদের সব চিন্তাভাবনা থামিয়ে দিলেন এই জানিয়ে যে, তারা আইসক্রিমে বড় আকারের পনিরই চান, ছোটগুলোর চেয়ে। ফলে বেনই ঠিক মেনে নিলেন জেরি।
এবার একটি গোপন তথ্য, বেনের ঘ্রাণশক্তি লোপের রোগ আছে। ইয়েল মেডিসিন খবর প্রকাশ করেছে যে, তার পুরো ঘ্রাণশক্তিই লোপ পেয়েছে। তারপরও তারা দুজনেই আইসক্রিমগুলোর স্বাদ ও গন্ধ পরীক্ষা করেন। বেন পনির ও পানির পরিমাণটি দেখেন। আসল স্বাদগুলো দেখেন জেরি। এরপর দুজনে তাড়িয়ে, তাড়িয়ে আইসক্রিমগুলো খান। চকলেটভিত্তিক, বাদাম মেশানো, চিপসের স্বাদগুলো মেশানোর দিকে আগ্রহ বেনের। তারপর সেখানে তারা কিশমিশ মেশানো শুরু করলেন। এভাবেই তাদের আইসক্রিমের ব্যবসা চলছে। আর দিন শেষে তারা সেই ছোটবেলার দুই প্রিয়তম বন্ধু হয়ে যান। তাদের মতে, ‘আমাদের বন্ধুত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সবকিছু।’ তখন থেকে যারা খেতে ভালোবাসতেন, তারা এসেছেন একত্রে ব্যবসায়ে। বেনের ব্যবসায়িক নীতি হলো, সৃজনশীল ও স্বত:স্ফুত আর জেরির হলো কৌশলী।
একবার বেন পড়ে গেলেন ও তার মাথা আহত হলো। গভীর ক্ষত হয়ে গেল সেখানে। তিনি তখন একটি কনসার্টে যাবেন। কিন্তু আহত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন, ততক্ষণে জেরি তাকে নিতে চলে এসেছেন। তিনি তার পাশে শুয়ে পড়লেন ও নিজের মাথাকে সেখানে সেভাবে আহত করে বন্ধুর আহত হওয়ায় নিজের ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তুমি কী ঠিক আছো? আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি? আমি ঠিক তোমার মতো তোমার পাশে পড়ে থাকতে যাচ্ছি।’
১৯৮৫ সালে তারা তাদের কারখানা চালু করলেন। এখন দিনে সাড়ে তিন লাখ পিস আইসক্রিম তৈরি করেন। তখন থেকে সাধারণ মানুষ তাদের এই কারখানাটি ঘুরে দেখতে পারেন। আন্তর্জাতিক কাজগুলোও তারা এখানে নেন। আছে ভেলমন্টের ওয়ারবুরিতে। সে বছরই “বেন অ্যান্ড জেরি’স ফাউন্ডেশন” গড়ে তুললেন তারা। তাদের কোম্পানির বার্ষিক আয়ের সাড়ে ৭ ভাগ মানুষের তরে বিলিয়ে দেওয়া শুরু করলেন প্রতিবছর। পরের বছর চালু করলেন ‘কাউমোবাইল’। তাতে তারা মোবাইল দোকানে তাদের পণ্যগুলো রাখতে শুরু করলেন। পুরো দেশে তারা এই মোবাইল দোকানের বিক্রি ও বিপনন শুরু করলেন। এটি ছিল তাদের আরেকটি বড় ব্যবসায়িক কৌশল। বিক্রেতারাও ব্যবহার শুরু করলেন। বড়, বড় কোম্পানিগুলোও ব্যাবহার করে। ১৯৮৭ সালে তারা জেরি গার্সিয়ার তারা প্রথম আইসক্রিম চালু করলেন। সেটি হলো কোনো বিখ্যাত মানুষের নামে তাদের আইসক্রিম বিক্রির শুরু। তিনি একজন রক গানের কিংবদন্তী। তার নামের এই আইসক্রিমকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘চেরি গার্সিয়া’। তাদের আরেকটি বড় ব্যবসায়িক কৌশল হলো তারা তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে ‘ফ্রি কয়েন ডে’ হিসেবে পালন করেন। সেদিন টাকা ছাড়াই আইসক্রিম খেতে পারেন আইসক্রিমপ্রেমীরা। এখনো চালু আছে। ২০০০ সালের এপ্রিলে তারা ইউনিলিভারের কাছে তাদের কোম্পানিটি বিক্রি করে দিলেন। কেননা বিশ্বজুড়ে যুদ্ধে আর পেরে উঠছেন না। তারপর থেকে তারা নিজেদের কম্পানিতে চাকরি করছেন। তবে কোনো ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা পদে নেই। তারপরও বেনকে গভনিং বোর্ড অব ডিরেক্টরসে রাখা হয়েছে। তবে এখনো “বেন অ্যান্ড জেরি’স” নামেই বিক্রি হয় তাদের আইসক্রিমগুলো।
ডিএসএস/