গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসি’র তথ্যচিত্রে জেরবার ভারত সরকার
ভারতের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে যে বিষয়টি, সেটি একটি তথ্যচিত্র। বিবিসি’র তৈরি এই তথ্যচিত্রটির দ্বিতীয় ভাগ গতকাল (বুধবার) লন্ডনে প্রকাশিত হয়েছে।
তারপর থেকেই ভারতে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে গুজরাত দাঙ্গার সেই ভয়াবহ ঘটনা। তথ্যচিত্রটি নাম ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন।
গুজরাট দাঙ্গার বিস্তারিত রিপোর্টের পাশাপাশি ওই তথ্যচিত্রটিত রয়েছে, ব্রিটিশ দূতাবাসের তৎকালীন প্রধানের গুজরাতের সেই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী জ্যাক স্ট্রকে পাঠানো একটি রিপোর্ট। রিপোর্টটি পাঠিয়েছিল দিল্লির ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের অফিস।
তাতে বিস্তারিত তৎকালীন ভরতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, গুজরাটর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহদের ভূমিকার কথা রয়েছে। ভারতে ওই তথ্যচত্রটি ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বিদেশ মন্ত্রকের তরফে সাফাই গাওয়ার সুরে বলা হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা থেকে ওই তথ্যচিত্রটি বানানো হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয়। ওই তথ্যচিত্রে তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রকের আধিকারিকদের সঙ্গে কথাবার্তার রিপোর্টও রয়েছে বিবিসি’র ওই তথ্যচিত্রে। এমনকি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককেও এই রিপোর্ট নিয়ে লন্ডনে বিরোধী এমপিদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় ভাগ, যেটি মাত্র বুধবারই প্রচারিত হয়েছে, তাতে আছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এবং ২০১৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার জিতে আসার পর এই সময়কালে ভারতের মুসলিমদের পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেওয়ার পর পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে।
গুজরাট দাঙ্গা ও তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর নির্মিত বিবিসি’র তথ্যচিত্র ভারতে ব্যান হওয়া প্রসঙ্গে আগেই মুখ খুলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়েছিল, এই তথ্যচিত্র খুবই বিতর্কিত। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মত বদলে অন্য অবস্থান নিয়েছে তারা। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন সকালেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এই তথ্যচিত্র ভারতে আটকে রেখে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, সারা বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও এবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো গণতান্ত্রিক নীতির গুরুত্ব তুলে ধরার এটাই সঠিক সময়। এভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায় না।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বুধবার জানিয়েছেন, তাদের দেশ বিশ্বজুড়ে মুক্ত গণমাধ্যমকে সমর্থন করে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে।
উল্লেখ্য, এর আগে ভারত সরকারের তরফে বিবিসির এই তথ্যচিত্র নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছিল। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বিবিসির বিতর্কিত তথ্যচিত্র নিয়ে বলেছিলেন, ‘এর পিছনে নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা রয়েছে।’
তবে বিবিসি জানিয়েছে, “এই তথ্যচিত্র তৈরির আগে বহু মানুষের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছে। এতে ওই সময়ের বহু প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত যেমন রয়েছে, তেমনই বিজেপির সদস্যদের প্রতিক্রিয়াও নেওয়া হয়েছে।’
যদিও পরে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সচিবের তরফে ইউটিউব ও টুইটারে সেই তথ্যচিত্র সংক্রান্ত যাবতীয় ভিডিও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। সূত্রের খবর, এই তথ্যচিত্রের লিঙ্ক সম্বলিত ৫০টিরও বেশি টুইট ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। এর মধ্যে বুধবারই তথ্যচিত্রটির দ্বিতীয় পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছে।
কলকাতাসহ দেশের একাধিক স্থানে ছাত্র সংগঠনগুলো এই তথ্যচিত্র দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিবিসির তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’দেখানোর উদ্যোগ ঘিরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটিতে। চার ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তারা তথ্যচিত্রটি নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল বলে পুলিশের অভিযোগ।
ছাত্রদের একাংশ বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ছ’টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ওই তথ্যচিত্র দেখানোর কথা ঘোষণা করেছে। এই খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। আজ দুপুরে চার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয় তথ্যচিত্র প্রদর্শনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়।
মঙ্গলবার দিল্লিতেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তথ্যচিত্র দেখানো নিয়ে তুমুল গোলমাল হয় দু’দল ছাত্রের মধ্যে। তথ্যচিত্রটি দেখানোর সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন ল্যাপটপে সেটি দেখানোর ব্যবস্থা করে ছাত্ররা। ছাত্রদের মোবাইলে ভিডিওটির কিউআপ কোডও বিলি করা হয়। অন্ধকারের মধ্যে শুরু হয় ইট মারামারি। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।
কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। তেলেঙ্গানায় হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গত সপ্তাহেই তথ্যচিত্র দেখানো হয় ছাত্রদের উদ্যোগে।
এমএমএ/