‘আমাদের ভালো কাজ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে’
সাদা-নীল শাড়ি পরা কলকাতার বস্তিগুলোর সাধু মাদার তেরেসাকে নিয়ে একটি বিশেষ রচনা লিখেছেন ফাদার জে. ফিলেক্স রাজ। তখন তিনি ভারতের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। মাদার তেরেসার ১০৯তম জন্মবার্ষিকী উপক্ষে রচিত বিশেষ রচনাটি অনুবাদ করেছেন ওমর শাহেদ।
আমাদের ১৯৯৪ সালের একটি আলোচনায় যখন আমি তার প্রার্থনা করলাম মাদার তেরেসা তারপর দুঃখকাতর একটি দৃষ্টি দিলেন আমাকে। তিনি আমার হাতের তালুতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে তার একটি জপমালা ঠেলে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার জন্য প্রার্থনা কর এবং আমার পরিত্যক্ত, নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীনদের কাজের জন্য প্রার্থনা কর।’ আবিষ্কার করলাম, এই মহামানবী তার ম্বর্গীয় আভা বিতরণ করলেন, সেটি আমার হৃদয়ের মর্মমূলে প্রবেশ করেছে। যে কথাগুলো বলেছেন, তার প্রতিটি শব্দ, যে স্পর্শ প্রদান করেছেন, তার সবগুলোই, যেভাবে তাকিয়েছেন, প্রতিবার; প্রতিটিই রূপান্তরিত রঙের আভায় ভরা ছিল।
তবে এই মাদার তেরেসাকে ভুল বোঝা হয়েছে, যার কোনোটিই কোনো প্রমাণ ছিল না, সমালোচকরা তাকে দোষ দিয়েছেন, তিনি ধর্মান্তরণের জন্য কাজ করছেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)’র প্রধান মোহন ভাগত ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযোগ করেছেন, সব হারানো মানুষদের জন্য মাদার তেরেসার কাজের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, তাদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরণ।
তিনি আরও বলেন, তার স্বার্থপর সংকল্প একটি মহৎ কারণের গুণাবলির মূল্য কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মহৎ কাজের নামে ধর্মীয় স্থানান্তরগুলো ঘটানো হয়েছে। সুব্রামানিয়ান স্বামী, একজন জ্যেষ্ঠ্য বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) নেতা ডাক দিয়েছিলেন, মাদার তেরেসার ‘ভারতরত্ন’ বাতিল করতে হবে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, যদি ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি (মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠান)’র দলটির দোষ খুঁজে পাওয়া যায়। ‘আমি একে একশ ভাগ সমর্থন করি...আমরা পুরোটাকে (মিশন) আবর্জনা তৈরি করছি না। আমরা জঞ্জাল তৈরি করছি মাদার তেরেসার তথাকথিত ‘সাধু’ মর্যাদাটিকে’, গণমাধ্যমকে তিনি বলেন।
মাদারের আত্মজীবনী রচয়িতা ও ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাভিন. বি. চাওলা একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তিনি কী মানুষকে ধর্মান্তর করার চেষ্টা করেছেন? উত্তরটি এভাবেই দিয়েছেন আলবেনিয়ায় বাবা-মায়ের দেওয়া ‘ছোট্ট ফুল’ নামের নারীটি, ‘হ্যাঁ আমি ধর্মান্তর করি। আমি তোমাকে আরও ভালো একজন হিন্দুতে ধর্মান্তর করি, আরেকজনকে আরও উন্নত খ্রিস্টানে, একজন শিখকে আরও ভালো শিখে এবং একজন মুসলমানকে আরও ভালো মুসলিম হতে। যখন তুমি ঈশ্বরকে খুঁজে পাবে, তখন তার সঙ্গে কী করবে সেটি তোমার উপর নির্ভর করে।’
জীবনের মহাকাব্যিক অংশে একজন ধর্মপ্রচাররিকা হিসেবে মাদার কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি একজন মানুষকেও ধর্মান্তকরণ করেননি। তিনি অসংখ্য জীবনকে, অনেককে পারস্পরিক আলাপনের মাধ্যমেও ধর্মান্তর করেছেন-মানবতার দিকে। নিজের ধর্মযাজকের ধর্মীয় অবস্থানের ঊর্ধ্বে ওঠে, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে।
তার বাণী, কথাগুলো বৈশ্বিক, বিশ্বব্যাপী। কোনো সমস্যাই তৈরি করে না যে মানুষটি কোনো ধর্ম অনুসরণ করেন, বিশ্বাসী তিনি কোনো ধর্মে? এমনকি তারা নাস্তিক হলেও, তারা জ্ঞানবাদী হলেও। মাদার তেরেসার জীবনের মূলমন্ত্র এবং তার আসল বাণীটি হলো, ‘ভালোবাসা নিয়ে সেবা করুন।’ তার জীবনের মন্ত্রটি হলো ধর্মীয় বিচারে, ‘আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান, আমাদের আরও ভালো কাজগুলো করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমাদের ভালোবাসতে ও ভালোবাসাতে আনা হয়েছে। নিত্য ও চিরস্থায়ী ভালোবাসা থেকে ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককে ভালোবাসেন। আমরা তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। ফলে, কোনোকিছুই আমাদের আলাদা করতে পারা উচিত নয়।’
এই হালকা-পাতলা নান, যাকে আমরা ‘তপস্বিনী’ বলতে পারি, ধর্মের বিচারে যিনি চলেন নিজের বিবেচনার মাধ্যমে, একটি নীল পাড় দেওয়া সাদা তাঁতের শাড়ি, সবসময়ের মতো পরেন, যোগ দিয়েছিলেন রোমান ক্যাথলিকদের একটি মেয়েদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, তার জীবনের ১৮ বছরে। কসোভো-আলবেনিয়ান এই মেয়েটির জন্ম হয়েছে ১৯১০ সালের ২৬ আগষ্ট। মাদার তেরেসা বা মাদার নামে বিশ্বজুড়ে আদৃত ও পূজিত মানুষটির জন্মনাম আগনেস গনজা বইয়াজু, তার দেশের ভাষা আলবেনিয়ান। জম্মেছেন অটোম্যান সম্রাজ্যের শাসনমালে, রাজধানী স্কোপিয়ে শহরে। এখন তার দেশ স্বাধীন, মেসিডোনিয়া, রাজধানী তার জন্মস্থান। মোটে ৮ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। একেবারে ছোটবেলা থেকে ধর্মপ্রাণ মেয়েটি মিশরারিদের গল্প পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বাংলায় তাদের কার্যক্রম দারুণভাবে টানতে আগসেনকে। ১২ বছর বয়স থেকে মিশনারিদের ধর্মীয় জীবনের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯২৮ সালে, ১৮ বছরের তরুণী আর্তের সেবার মাধ্যমে ধর্মীয় জীবন কাটানোর জন্য বাড়ি ত্যাগ করে মিশনারিদের কাছে চলে গেলেন আয়ারল্যান্ডের লরেটো হাউজে, র্যাফফারনেমে। সেখানে আলবেনিয়ান ইংরেজি শিখতে লাগলেন বাংলার সিস্টারদের ভাষা জানতে। তাদের ‘তেরেসা’ তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুলো গ্রহণ করেছেন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দাজিলিংয়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ১৯২৯ সালে তিনি চলে এলেন ভারতে। পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় তাদের প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত নামকরা ও প্রথম লরেটো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বালিকা বিদ্যালয় লেরেটো হাউজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন ও তার শিক্ষা দিয়েছেন।
১৯৪৬ সালে ট্রেনে একবার দাজিলিংয়ে যাবার সময় তিনি তার ভাষায় একটি ডাকের মধ্যে আরেকটি ডাক গ্রহণ করেছেন। ‘বাণী বা বার্তাটি ছিল একেবারেই পরিষ্কার। আমাকে লরেটো কংগ্রেশন ত্যাগ করতে হবে এবং চলে যেতে হবে আজীবনের জন্য সাহায্য করতে গরীবদের, তাদের মধ্যে বাস করতে হবে’ বলেছেন মাদার তেরেসা।
১৯৫০ সালের অক্টোবরের ৭, মাদার তেরেসা, ৪০ বছরের যুবতী আলবেনিয়ান, ঐশ্বরিক আলোয় আলোকিত হয়ে তার সুবিখ্যাত ‘দি মিশরারিজ অব চ্যারিটি’ প্রতিষ্ঠা করলেন কলকাতার বস্তিতে মোটে ১২ জনকে নিয়ে। যাদের কেউ দেখতে প্রস্তুত নয়, রাজি নয়, তাদের ভালোবাসা ও যত্নের মাধ্যমে সেবাদান করতে তারা জীবনের উদ্দেশ্য স্থাপন করলেন। ১৯৬৫ সালে পোপ পল-৬’র আনুষ্ঠানিক লিখিত আদেশে একটি আন্তর্জাতিক ধমীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হলো ‘দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি’। ২০১৯ সালের ২৫ আগষ্ট এই লেখাটি প্রকাশের তারিখানুসারে, সারা বিশ্বে ‘দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি’তে আছেন ৪৫ হাজারের বেশি সিস্টার বা সেবিকা। তারা এতিমখানাগুলো পরিচালনা ও সেবা প্রদান করেন, এইচআইভি এইডস রোগাক্রান্ত মরণাপন্নদের সেবাদান কেন্দ্রগুলোতে কাজ করেন, তাদের জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য দাতব্য কেন্দ্রগুলো রয়েছে। বিশ্বজুড়েই ছড়ানো মাদার তেরেসার এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা শরনার্থীদের সেবাদান করেন, অন্ধ ও চলৎশক্তিহীনসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্তদের সেবা প্রদান করেন। তাদের আছে বয়স্ক সেবাদান কেন্দ্র, মাদকাসক্ত দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র, গরীবদের জন্য সেবা কর্মসূচি, গৃহহীনদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পাক্রন্তদের সাহায্য করেন তারা। নারী ও শিশুদের জন্য তাদের সুবিখ্যাত কর্মসূচি রয়েছে। যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনায় তাদের আশ্রয় ও সেবা চলছে।
এই ধারাবাহিক জীবনের সেবাপ্রদান কাজে ১৯৫২ সালে মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে ৪২ বছরের মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠা করলেন ও গড়ে তুললেন ‘নির্মল হৃদয়’, একটি অত্যন্ত বিখ্যাত আশ্রয়কেন্দ্র নিঃস্ব মৃত্যুপথযাত্রীদের বাঁচানোর জন্য, ভারতের কলকাতার কালীঘাটের কালী মাতার একটি পরিত্যক্ত মন্দিরে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে দারিদ্রতার কষাঘাতে মরতে বসা বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের তিনি ও তারা মর্যাদা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার জীবন প্রদান করা শুরু করলেন। তাদের জীবনকাল আরো বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
আমার নির্মল হৃদয়ের মানুষদের গিজার যাজকের জীবনের নিয়মে একটি মাস সেবা প্রদানের সুযোগ হয়েছে ৪০ বছর আগে, ১৯৭৯ সালে। ছিলাম একজন ভলান্টিয়ার বা তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। হাজার, হাজার, লাখ, লাখ নারী ও পুরুষ বয়স্ককে সেবা দিয়ে চলেছে আমাদের ‘নির্মল হৃদয়’।
আশ্রমবাসী লাখ, লাখ মানুষ সম্মানিত হয়েছেন, বেঁচে থেকেছেন। তারা সবাই তাকে ‘সাধিকা’র মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। মাদার তেরেসা ও তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক আগে থেকে খ্রিস্টানদের কংগ্রেশন বা ধর্মীয় মর্যাদায় আপন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তার প্রতিষ্ঠান ‘দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ এই লেখাটির হিসেবে ১৩৬টি দেশে ৭শর বেশি বিশেষ বাড়ি চালু করেছে। তাদের পর্বতপ্রমাণ ভালোবাসা ও বিশ্বাসে লাখ, লাখ মানুষ বেঁচে আছেন। এমনকি ফিদেল কান্ত্রো-বিশ্বনমস্য কিউবান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ও কিউবার প্রেসিডেন্ট তার রাজধানী হাভানাতে একটি মিশনারিজ অব চ্যারিটি চালু করেছেন। এই ঘটনা ১৯৮৬ সালে। পরের বছর ১৯৮৭ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজি হলো, মাদার তেরেসা তার নানদের রাজধানী মস্কোতে কাজ করতে পাঠাতে পারবেন। তিনি তার জন্মভূমি আর্মেনিয়াতে গেলেন ভমিকম্পে বিধ্বস্তদের সাহায্য প্রদানের মহতী কার্যক্রম নিয়ে।
এখন মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেন জার্মানিতে জন্ম নেওয়া, বার্লিনে মাদারের সঙ্গে সংযুক্ত ভারতবাসী ক্যাথলিক ধর্মীয় বোন বা ‘সিস্টার ‘প্রেমা প্যাট্রিক এম.সি. (এম.সি. মিশরারিজ অব চ্যারিটির প্রদত্ত সর্বোচ্চ ডিগ্রি)’। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তাদের সবল ধর্মীয় বিশ্বাস, নিষ্ঠাবান জীবন ও সিস্টার মেরি প্রেমার অসাধারণ নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এখন তিনি ৬৯।
দ্য জেসুইট ফাদারর্স বা যীশু খ্রিস্টের ফাদাররা, যারা কলকাতা নিবাসী, তারা প্রত্যেকে মাদার তেরেসার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করেছেন। তাদের সমথর্নগুলো মাদার লাভ করেছেন সর্বত্র। আমাদের কলকাতার বিশ্বখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ১৮৬০ সালের, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তার পরিচালক, ফাদাররা সবাই তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তারা প্রত্যেকে তাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মাদার তেরেসার জীবন, কাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জেভিয়ার্সের ফাদাররা বলেন, ‘একটি পেশার মধ্যে আরেকটি পেশা।’ তাদেরও তাই-শিক্ষাদান ও গ্রহণ।
আজীবনের শিক্ষার্থী ছিলেন নারীটি, বিশ্বখ্যাত ‘মাদার তেরেসা’। এই প্রসঙ্গে সিলেক্স ভ্যান এক্সাম আসবেন। তিনি ১৯০৮ সালের ৪ অক্টোবর জন্মেছেন ও মারা গিয়েছেন দীর্ঘজীবনকাল পেরিয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। বুলগেরিয়ার এই ফাদার ১৯৪৪ সাল থেকে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কলকাতায় বাস করেছেন। কলকাতার শহরতলীতে মাদার তেরেসার সঙ্গে দেখা করেছেন তার লরেটো স্কুলের জীবনে। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন ফাদার ভ্যান এক্সাম। বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব লুভান থেকে অনার্স। পড়েছেন সিরিয়া ও মিশরেও খ্রিস্টান পাদ্রিদের জীবনে। মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির গঠন ও প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে কাজ করেছেন ফাদার সিলেক্স ভ্যান এক্সাম। ১৯৯৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাদারের উপদেষ্টার কাজ করে গিয়েছেন।
মাদার তেরেসা কখনো তার আত্মিক ও নৈতিক এবং কার্যকর সমর্থনের জন্য সেন্ট জেভিয়ার্সে প্রতি সপ্তাহে যেতে ভুলতেন না। সেখানে ফাদারদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের অন্যতম ফাদার এডোরাড লো জোলি মাদার তেরেসার ওপর মোট ২১টি বই লিখে নির্দিষ্টভাবে তার জীবনের উদ্দেশ্য প্রচার করেছেন। অন্যতম-‘হোয়াট উই ডু ইট ফর জেসাস: মাদার তেরেসা অ্যান্ড হার মিশনারিজ অব চ্যারিটি’, ‘সার্ভেন্ট অব লাভ: মাদার তেরেসা অ্যান্ড হার মিশনারিজ অব চ্যারিটি’, ‘মাদার তেরেসা: অ্যা উইম্যান ইন লাভ’, ‘মাদার তেরেসা অব ক্যালকাটা: অ্যা বায়োগ্রাফি’।
মাদার তেরেসার আরেকজন আত্মজীবনীকার নাভিন চাওয়া একবার ভারতের সবচেয়ে বেশিদিনের গণতান্ত্রিক রীতিতে মুখ্যমন্ত্রী-১৯৭৭ থেকে টানা ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের একটানা রাজ্য সরকার প্রধান কমিউনিস্ট নেতা ও অন্যতম পথিকৃৎ জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনার ও মাদার তেরেসার মধ্যে মৌলিক মিল কোনটি, যেটি আপনি কমিউনিস্ট এবং নান্তিক হিসেবে ও মানবকর্মী এবং আস্তিক হিসেবে মাদার ধারন করেন?’ উত্তরে কমিউনিস্ট জীবনাদর্শের অন্যতম নেতা হাসলেন এবং বাঙালির ছেলেটি বললেন, ‘একেবারে শুরুতে, যখন কর্মীরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন একজন খ্রিস্টান নান (ভিক্ষুক) কে সাহায্য করছেন?’ উত্তরে বলেছি, ‘যেদিন তোমরা যেকেউ কোনো কুষ্ঠ রোগীর শরীরের ক্ষত পরিস্কার করতে পারবে সেদিনই আমি তাকে চলে যেতে অনুরোধ করব।’ দিনটি আর কখনো আসেনি।’
বিশ্বের হাজার হাজার মানুষকে, শত, শত নারীকে তার জীনাদর্শের প্রতি আগ্রহী ও অনুসারী করতে পেরেছেন আলবেনিয়া থেকে ভারতবাসী মাদার তেরেসা। এমনকি বিশ্বনেতারা তাকে সম্মানিত, স্বীকৃত ও সাহায্য করেছেন আজীবন। তিনি আমাদের মধ্যের একজন, গরিবদের একজন, মৃত্যুপথযাত্রীদের সহায়, নিঃস্বর ভালোবাসা। তাদের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। মাদার তেরেসা তার জীবনে আরো প্রমাণ করেছেন, ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল জীবন পরিচালিত করা সম্ভব হয় মানুষের জন্য কর্ম করেও।
মাদার তেরেসা ঈশ্বরের ক্ষমা ও পাপমোচনের একজন উদাহরণ। তিনি তার গরিবদের জন্য ভালোবাসার স্বীকৃতি। তিনি প্রান্তিকদের জন্য বিশ্বের সহায়। তার এই জীবনের একেবারে শুরু থেকে তার মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত গভীর পবিত্রতায় ভরা। এই কারণে মাদারের মৃত্যুর কদিনের মধ্যে তাকে তাদের খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মযাজক পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত একজন সাধক হিসেবে ঘোষণা করেছেন, ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তার আবাস ইতালির রাজধানী রোমে তাদের স্বাধীন রাজ্য ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার’স স্কয়ারে।
মাদার তেরেসার সাধিকার জীবন আমাদের সবাইকে তার পদাঙ্ক অনুসরণের সুযোগগুলো তৈরি করে দিয়েছে। সেই পথ ধরে আমরা গরীবের মধ্যে সবচেয়ে গরীব, অসহায় এবং অসুস্থদের মধ্যে সবচেয়ে অসহায় ও অসুস্থদের সেবা করে ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও কৃপা লাভ করতে পারি। একজন সাধুর এই দীর্ঘজীবন মাদার তেরেসারই ছিল। কলকাতায় আমাদের জন্য তিনি উদযাপনেরও গান ছিলেন, সুস্থ্যতার বিনিময়ে, খাবার লাভের দৌলতে, নিজেই ছিলেন স্তবগান, ছিলেন সহানুভূতির আদর্শ। আমি বিশ্বাস করি, এই আনন্দনগর তার এই নায়িকার জীবনের মাধ্যমে আলো ছড়ানো অব্যাহত রাখবে।
তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে একজন ফাদার হিসেবে আমার মাদার তেরেসার সঙ্গে আজীবনের সম্পর্ক ছিল, গভীর কর্মসম্পর্ক ছিল। অনেক কারণে আমি তাকে কলকাতার তরুণ সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেছি, যেহেতু আমাদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছি। আমাদের আমন্ত্রণে অনেক অনুষ্ঠানে তরুণ, তরুণীদের সামনে এসেছেন মাদার তেরেসা, বিভিন্ন আয়োজনেও আমি তাকে নিয়ে গিয়েছি। তাদের সবার সামনে সবখানে মাদার তার চরিত্রসুলভ হাসি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি মানবতার উদাহরণটি উপস্থাপন করেছেন। তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন অসাধারণ দূরদর্শী এই নারী নিজেকে সবসময় সেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তার চরিত্রগুলোতে বরাবরের মতো তার প্রার্থনার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, গভীর শ্রদ্ধাবোধের জন্ম হয়েছে সবার মাঝে। সবসময় সবাইকে উদ্দীপনা প্রদান করেছেন ও যুগিয়ে গিয়েছেন। যতবার তাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন তাদের জন্য ভালোবাসা বয়ে এনেছেন।
৩০ বছর আগে, ১৯৮৯ সালে আমাকে যেতে হয়েছে ‘দ্য মাদার হাউজ’-এ, যীশু খ্রিস্টের পবিত্র নৈশভোজের উপহারগুলো নিয়ে, তার সিস্টার বা বোনদের জন্য। তিনি তাদের প্রধান হিসেবে আমার সামনে পবিত্র, বিস্তৃত ও বিকীর্ণ হাসি নিয়ে এলেন। তিনি নিয়মানুসারে ভদ্রভাবে আমার হাতে চুমো খেলেন ও আমাকে তার জন্য প্রাথর্না করতে নতজানু হয়ে গেলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত ও অতি বিচলিত হয়ে গেলাম, যেহেতু জানি, তিনি কে আমাদের মধ্যে? বলেছিলাম, ‘মাদার আমি কে যে আপনাকে আর্শীবাদ করব? তারচেয়ে আপনার আমাকে আর্শীবাদ করা উচিত।’
আমাকে অত্যন্ত সুন্দর, ভদ্র একটি হাসি উপহার দিলেন তিনি ও বললেন, ‘আপনি একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক, একজন নতুন নিযুক্ত তরুণ যাজক, আমি জানি। ঈশ্বরের একজন প্রতিনিধি, ফলে আমি আপনার আর্শীবাদ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়েছি।’ আমি তাকে এতিমের মতো প্রচুর পরিমানে আর্শীবাদ করেছিলাম। এরপর দ্রুত নতজানু হয়ে গেলাম এবং তার আর্শীবাদ ভিক্ষা করলাম। আমি লাভ করেছিলাম। আমার জীবনের অনন্য, অভোলনীয় এবং রূপান্তরিত মুহূর্ত হয়ে রইলো সময়টি।
মাদার তেরেসার বিশ্বাসের একটি অংশ ছিল, তিনি মনে করতেন, তার কাজগুলো চাওয়া হয়েছিল, তার মানে ঈশ্বর হয়তো প্রদান করবেন। এই মহামতী নারী তার নামে কোনো ধরনের আর্থিক সাহায্য কারো কাছে চাইতেই নিষেধ করে দিয়েছিলেন তার কর্মীদের। তাতে মাদারের জীবনাদর্শের ভিত্তিতে কোনো ধরনের ভিন্নতা তৈরি হয়নি, বানের জলের মতো তার কাজের দৌলতে সাহায্য এসেছে নানাপ্রান্ত থেকে, নানাভাবে, নানাজনের পকেট থেকে।
মাদার তেরেসার সুনাম ও খ্যাতি তার প্রতি অভেদ্য অনুরাগ তৈরি করেছে সবার। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ব নেতারা সবাই, শিক্ষাবিদরা, ধর্মীয় নেতরা সবাই এবং একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরা প্রত্যেকে। নারী ও পুরুষ সকল জাতের, সব দেশের। তিনি তার জীবনে সবার আর্শীবাদে একই বন্ধুত্বপূণ, বিনম্র আচরণ করেছেন আজীবন, একই ভালোবাসা ও নিষ্ঠায় মৃত্যুপথযাত্রীদের সেবা করেছেন, নিঃস্বের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন।
যখন মাদার তেরেসাকে সমালোচনা করা হলো, তার যেকোনো ক্ষেত্রে স্বীকৃত প্রভাবকে নিয়মতান্ত্রিক শয়তানদের জন্য, যেমন অস্ত্রের ব্যবসা ও যুদ্ধ, সংঘাত, নিয়মতান্ত্রিক শোষণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায়, অবিচারের বিপক্ষে তার সময়কে ব্যবহার করছেন না। সামান্যভাবেই উত্তর দিয়েছেন, এই কাজগুলো তার জীবনের উদ্দেশ্য নয়, কর্মের ভুবন নয়, তা অন্যদের ওপর বর্তায়, রাখা আছে কাজগুলো নেতাদের জন্য।
১৯৮২ সালে প্রদান করা একটি সাক্ষাৎকারে মাদার বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই যাদের এই বিষয়গুলোতে কোনো জ্ঞান নেই, তাদের সুবিচার, রাজনৈতিক ভুবনের সত্য লাভের জন্য উঠে দাঁড়ানোতে উৎসাহিত করতে হবে।’
সবসময় তিনি যেকোনো পরিস্থিতিকে তার মতো করে মোকাবেলা করেছেন এবং থেকেছেন সাহসী তার কাজের ভুবনে ও প্রদান করে গিয়েছেন এই বিশ্বের সব মানুষকে অনন্য উৎসাহ। তার জীবনটি তাই হয়েছে অনুকরণীয়। তার বিপক্ষের সমালোচনাগুলোকেও ভালোভাবে, সৎভাবে, বিনয়ের সঙ্গে, আপন কর্মের উত্তরে নিয়েছেন। প্রায়ই তার সমালোচকদের উত্তর দিয়েছেন তার স্বীয় বাকপটুতায়। তিনি তার কর্মের মাধ্যমেই এগিয়েছেন। জীবনের আরেকটি দিক হলো, পূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাস, তিনি নিষ্ঠাবান যাজিকা হিসেবে প্রভু যিশুর প্রতি অনন্য অনুসরণকারী ছিলেন, অনুকরণীয় তো বটেই। ঈশ্বরের আর্শীবাদ লাভের জন্যই মানবের তরে সবকিছু করেছেন। মাদার তেরেসার জীবন থেকে জানা যায়, ঈশ্বরের শান্তি লাভের জন্য তার একটি যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে গিয়েছেন সারাজীবন।
মাদার তেরেসা, যিনি তার জীবনের মাধ্যমে এই বিশ্বের সকল রংদার বিষয়কে কঠোরভাবে উপেক্ষা করেছেন, তাকে এই পৃথিবী সেজন্যও সম্মানিত করেছে। তাকে সাহায্য করেছেন সকলে উন্মুখভাবে। তিনি জীবনে অসংখ্য পদক ও সম্মানে ভূষিত হয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের কাছ থেকে। নোবেল জয়ের পর ভারত তাকে ১৯৬২ সালে প্রদান করেছে সেরা সম্মান ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৭১ সালে লাভ করেছেন তাদের খ্রিস্টধর্মগুলোর সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব পোপ জজ-অ্যাঞ্জেলো জুজেপ্পে রনকালি’র কাছ থেকে তাদের প্রধান ‘শান্তি পুরস্কার’, ভ্যাটিকান দিয়েছে। তার কাজকে সম্মানিত তো নোবেল শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমেই করেছেন বিশ্ববাসী।
এরপর থেকে তার কাজ ও জীবনকে অবিরল ধারায় গণমাধ্যম অনুসরণ করে গিয়েছে সব দেশে। আরও অনেক সামনে চলে এসেছেন। তার জীবনের সকল পুরস্কারই ‘ঈশ্বরের মহিমা প্রদর্শনের জন্য এবং গরিবের নামে’ গ্রহণ করেছেন তিনি।
২০১০ সালে মাদার তেরেসা মারা যাওয়ার ১৩ বছর পর, তার জন্মশতবর্ষে কর্মজীবন কাটানো দেশ ভারতের ‘দ্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেছে মাদারের নামে নতুন ‘৫ রুপি’র মুদ্রা চালু করে। তারা তার জন্মশতবর্ষের উল্লেখ করেছেন। এই মুদ্রা দুপাশেই মধ্যখানে মাদার তেরেসা খোদিত রয়েছেন, ওপরের বামপাশে মুদ্রার শুরুতেই লেখা আছে হিন্দিতে, ভারতের প্রধান ভাষায়, বিদেশি এই মহিয়সীর গৌরব কীর্তনের জন্য, ‘মাদার তেরেসা’, আরও আছে হিন্দিতে তাদের তখনকার বিশেষ ধমীয় উৎসব ‘জন্মাষ্টমী’-ভগবান শ্রীকৃষ্ণর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আগষ্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে হিন্দুরা সারা বিশ্বে ধর্মীয় উৎসবটি পালন করেন। ডান পাশে লেখা আছে তার-‘জন্মশতবার্ষিকী’। মাদারের ছবির নিচে উৎকীর্ণ রয়েছে তার গৌরবময় জীবন ‘১৯১০-২০১০’।
মাদার তেরেসা ব্যঘ্রতার সঙ্গে অবগত ছিলেন ও কাজ করেছেন আজীবন যে, তার পুরো শক্তি ও তার অনুসারীদের সর্বোচ্চ শ্রম ঈশ্বরের ডাকে নিবেদিত রয়েছে গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে গরিবদের সবচেয়ে প্রয়োজনে। একবার একজন সাংবাদিককে বলেছেন, ‘তাকে ঈশ্বর ডাক দিয়েছেন তাদের জন্য শ্রম দিতে বা তাদের সেবা করতে, যারা দাঁড়াতে পারেন না, যারা কোনো কাজ করতে পারেন না। যাদের কোনো উপায় নেই। এই তার জীবনের কাজ।’
যখন মাদারের কথা ভাবি, তখন আমার কাছে সবসময় এই বিশ্বইতিহাসের অন্যতম আত্মনিবেদনকারী এবং গরিব শ্রমিকের কথা মনে পড়ে, যিনি হিন্দুদেবী দুর্গা-ভারতের বহু প্রাচীন শহর কলকাতার মানুষদের জন্য সাংস্কৃতিক যোগাযোগ।
মাদার তেরেসা হলেন আমার চোখে বিশ্বজনীন মাতৃপ্রতিরূপ। নিঃসন্দেহে কলকাতা প্রথম তার দুর্গার মতো জীবিত মাতৃরূপ মাদার তেরেসাকে তৈরি করতে পেরেছে। এরপর তিনি আপনাকে গড়েছেন ‘সাধু তেরেসা’ নামে। তিনি তার জীবনে দারিদ্রের শয়তানকে ভেঙে ফেলতে কাজ করছেন এবং এই কারণে ও রোগে শোকে মানুষের ভেতর থেকে চলে যাওয়া অমানবিক বিষয়গুলোকে তাড়িয়ে মানবতার জন্মদান করেছেন। সত্যিকারের শান্তিকে কাজের মাধ্যমে সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বিশেষত যারা একেবারেই উপায়হীন, শান্তির পথে অচল। আকুলভাবে তিনি ও তার অনুসারী সাধিকারা একতান করেছেন মানবিক একতাকে, যেটি ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে, তাদের মাদার তেরেসার আর্তের সেবার ধর্মপ্রচারকের জীবনে, তারা মানুষের মধ্যে মানবিক দূরত্ব দূর করেছেন। তিনিই আরোগ্য করেছেন আমাদের ইঁদুর দৌড় ও তার ফলাফলগুলো।
আজীবন ঈশ্বরে প্রবলভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন মাদার। তিনি মানব জীবনের মানে প্রমাণিত করেছেন এবং আমাদের প্রত্যেকের মাঝে বেঁচে থাকা ঈশ্বরের ভালো দিকগুলোকে প্রতিরূপ করেছেন নিজের জীবনে। নিজের জীবনে শিষ্ঠাচার, দয়া, বিনয় ও সৌজন্যতার মাধ্যমে অন্যদের এই বোধগুলোকে জাগ্রত করেছেন ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কও স্থাপন করেছেন কর্ম দিয়ে।
মাদার তেরেসা বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকে মহান কাজগুলো করতে পারেন না। তবে আমরা ছোট ভালো কাজগুলোই করতে পারি অসাধারণ ভালোবাসার মাধ্যমে।’
১৯৬২ সালে এশিয়ার নোবেল র্যামন ম্যাগসাইসাই ও ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পুরস্কারজয়ী, ক্যাথলিক ধর্মযাজিকা ৮৭ বছরের মাদার তেরেসা মারা গিয়েছেন বিশ্বের সব মানুষকে কাঁদিয়ে ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সেই শহরে চলে গিয়েছেন, যাকে নিজের জীবনের বিনিময়ে তৈরি করেছেন আপন আভায়। সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করল মাদার তেরেসার শোকে। পশ্চিমের দেশগুলোকে শোকে আকুল হলো। মাদার তেরেসাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাহিত করেছে ভারত, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে। তার শোকবাণী বলেছেন তারা, ‘প্রতিটি শুরুরই একটি সমাপ্তি রয়েছে এবং প্রতিটি শেষের একটি শুরু রয়েছে। মাদার মারা যাননি। এমন একটি জীবন সমাপ্ত হতে পারে না, জীবন ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারে না। তিনি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সেতুবন্ধন গড়েছেন, তার উত্তারাধিকার প্রবাহিত হয়ে চলেছে তার সিস্টারদের হৃদয়ের মাধ্যমে, অনুসারীদের জীবনে।’
এই বছরের (২০১৯) ২৬ আগস্ট মাদারের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী। আমি সৌভাগ্যবান ও তার আর্শীবাদপুষ্ট যে, তাকে নিয়ে কাজ করতে পারলাম। আমার জন্মদিন তার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। তার সেই প্রিয় কথা আমাকে সবসময় উদ্দীপিত করে, ‘নিঃশব্দের ফলটি হলো প্রার্থনা, প্রার্থনার ফলটি হলো বিশ্বাস, বিশ্বাসের ফলটি হলো ভালোবাসা, ভালোবাসার ফলটি হলো কর্ম এবং কর্মের ফলটি হলো শান্তি।’
লেখক: ফাদার জে. ফিলেক্স রাজ (জন ফিলেক্স রাজ), একজন জেসুইট ধর্মপ্রচারক, শিক্ষাকে তার ধর্মপ্রচারের মাধ্যম করতে পেরেছেন। ভারতের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে এই বিশেষ নিবন্ধটি রচনা করেছেন। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রেক্টর ও ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রিন্সিপাল বা অধ্যক্ষ ছিলেন। তামিলনাড়ুর এই সাধু ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে পিএইচডি।
ওএফএস/