৪০ বছরের ‘যুদ্ধজয়ী’ আনোয়ার ইব্রাহিম
মালয়েশিয়ার জননন্দিত রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিম একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নেতা। বারবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা অধরাই থেকে গেছে। উল্টো মিথ্যা মামলায় জেলে খাটাই যেন ছিল তার নিয়তি। ১৯৮২ সাল থেকে রাজনীতির ভুবনে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তরুণ আনোয়ার ইব্রাহিম, দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে আজ তিনি সফল হলেন। মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গেও তার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল চমকপ্রদ ও বৈরিতায় মুখর।
আনোয়ার ইব্রাহিমের বয়স এখন ৭৫। প্রথম নিজের নামটি তৈরি করেছেন একজন ক্যারিসমাটিক ও আগুনের মতো জ্বলে ওঠা ছাত্রনেতা হিসেবে। তিনিই তখন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালয়শিয়ার মুসলিম তরুণদের সংগঠন ‘আনকাতান বালিয়া ইসলাম মালয়শিয়া (এবিআইএম)’। তবে এরপর অনেককে অবাক করে দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি যোগ দেন ‘ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অগানাইজেশন (ইউএমএনও)’-এ।
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বহু পুরোনো ইউএমএনও দলে যোগ দেওয়া ছিল তার একটি বিচক্ষণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানেই নিজেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বারবার ওপরে উঠিয়েছেন এবং মন্ত্রীসভাতে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় মাহাথিরকে তিনি প্রত্যাশা মিটিয়ে ব্যাপক সাফল্য লাভে সহায়তা করেন।
তবে তাদের দুজনের মধ্যে উত্তেজনার শুরু হলো ১৯৯৭ সালের এশিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে। তারা দুজনেই ধাক্কা খেয়ে গেলেন অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও দুর্নীতিতে। পরের বছর ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত করা হলো এবং তিনি মাহাথির মোহাম্মদের বিপক্ষে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন। এই আন্দোলনই মালয়শিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি প্রজন্মকে উৎসাহিত ও বেগবান করেছে। আন্দোলনের নেতা আনোয়ার গ্রেপ্তার হন এবং তার বিপক্ষে সমকামিতা ও দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়।
শুনানিতে তিনি বিতর্কিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন। যেহেতু মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়া সমকামিতার কার্যক্রমগুলোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে, তারপরও তাকে মামলাগুলোতে দোষী সাব্যস্ত করা বিরল হয়ে গেল প্রমাণের অভাবে। আনোয়ার ইব্রাহিম রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলার শিকার হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানালো। তারপরও তার ছয় বছরের কারাদণ্ড হলো। এরপর ভয়াবহ সহিংস সংঘাত দেশের রাস্তায়, রাস্তায় ছড়িয়ে গেল। এক বছর পর আনোয়ার ইব্রাহিম সমকামিতার জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন।
আনোয়ার ইব্রাহিম সবসময় উল্লেখ করেছেন যে, মাহাথির মোহাম্মদ তাকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে মনে করেন। আর এজন্য তিনি তার বিপক্ষে প্রচারণা ও কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অভিযোগ ও শাস্তি প্রদান করার পাঁয়তারা করছেন।
২০০৪ সালের শেষের দিকে মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হলে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতার মামলায় উল্টো অবস্থান নেয় এবং আনোয়ারকে জেল থেকে মুক্তি দেয়।
তারপর থেকে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি নিজেকে আরও মজবুত অবস্থানে নিয়ে যান। যখন জেল থেকে মুক্ত হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম, তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে মাহাথির মোহাম্মদের বিপক্ষে বাস্তবে ও কার্যত সবার প্রধান হিসেবে তুলে ধরতে লাগলেন।
২০০৮ সালের নিবাচনে তার দল শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন। তবে সে বছর আবার তার বিপক্ষে সমকামিতার অভিযোগ তৈরি করা হলো। তিনি দাবি করলেন, তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে এটি সরকারের আরেকটি পদক্ষেপ। অবশেষে ২০১২ সালের হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আনোয়ার ইব্রাহিমকে সব মামলা থেকে মুক্ত করে দেয়। তারা জানালেন, প্রমাণের অভাব রয়েছে।
পরের বছর তিনি নির্বাচনে প্রধান ভূমিকা পালন করলেন ও নতুন মাত্রা তৈরি করলেন। ফলে তিনি ক্ষমতাশীল ‘বারিশান ন্যাশনাল কোয়ালিশন (বিএনসি)’র ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল এনে দিলেন। তবে আবারও আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক আশাগুলো হুমকির মধ্যে পড়ে গেল। ২০১৪ সালে তিনি একটি রাজ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যে মামলাগুলোতে আদালতের বিচারে খালাস পেয়েছিলেন, সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনা হলো এবং তাকে জেলে বন্দী করা হলো। তবে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে বহু পুরোনো ও দক্ষ খেলোয়াড় এবং মাহাথির মোহাম্মদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কখনো কোনোভাবেই দমে যাননি। তিনি বারবার সামনে আসার চেষ্টা করেছেন।
এর মধ্যে নানা ঘটনায় সবাইকে চমকে দিয়ে ২০১৬ সালে তার সাবেক শত্রু মাহাথির ঘোষণা করলেন, তিনি অবসর বাতিল করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য আবার লড়বেন। তখন ৯২ বছরের মালয়েশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নেতা জানালেন, তার বিপক্ষে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের আনীত দুর্নীতির মামলাগুলোতে দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। এসময় তিনি জেলে বন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে একটি অচিন্তনীয় চুক্তি করলেন। তিনি বিরোধী সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় তখন। তাকে জেল থেকে মুক্ত করলেন। দেশের জনগনকে খুশিতে ভাসিয়ে তারা একত্রে বসলেন ও আলোচনা করলেন, করমর্দন করলেন। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে একটি অসামান্য রাজনৈতিক পূণমিলনী ও ঐক্যের সূচনা করলেন।
মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক ঐক্যের ‘দি পাকাতান হারাপান অ্যালায়েন্স’ বা আশার মৈত্রী’র নেতৃত্ব দিলেন। থামিয়ে দিলেন বারিশান ন্যাশনাল’সদের ৬১ বছরের টানা দেশটিকে শাসনের ইতিহাস। তাদের এই রাজনৈতিক ঐক্যে মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সত্যিকারেভাবে এবং প্রথমবারের মতো নানা ধর্মের মানুষরা এলেন চারটি দল থেকে। তারা লাভ করলেন দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান, শক্তিশালী চীনা ও ভারতীয় সংখ্যালঘুদের সমর্থন। আবার মালয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাহাথির মোহাম্মদ নির্দিষ্টভাবে জানালেন যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তিনি তাকে আদালত থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করলেন ও তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দেবেন।
তবে তাদের রাজনৈতিক ঐক্য অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক হতে লাগলো যখন নব্বই বছর বয়সী মাহাথির তার ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলেন। ফলে আবার মালয়েশিয়ান জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে তাদের ঐক্যে ভাঙন ধরে। এর মাধ্যমে আবার খালি হাতে ফিরে গেলেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
এরপর আবার ক্ষমতায় এলো ‘ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও)’, নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন মহিউদ্দন ইয়াসিন। তবে মোটে এক বছর পর, মহামারি করোনার সবচেয়ে খারাপ সময়ে প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন কয়েক মাসের টালমাটাল অবস্থার পর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর পদত্যাগ করেন। গত অক্টোবরে তার দলে উত্তরাধিকারী ইসমাঈল সাবরি ইয়াক্বু ক্ষমতা কামড়ে ধরবেন বলে এগুলেন। ইউএমএনও নিশ্চিত হলো যে, তারা নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে আবার ক্ষমতা দখল করতে পারবে। নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের জাদু ও দূরদর্শিতায় পাকাতান হারাপান অ্যালায়েন্স বেশিরভাগ সিট দখল করে।
টানা ৪০ বছর রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সংগ্রাম সফল হলো আনোয়ার ইব্রাহিমের। তিনি হলেন দেশটির ১০তম প্রধানমন্ত্রী।
ওএফএস/আরএ/