চক্ষু চিকিৎসক থেকে যেভাবে আল-কায়েদার প্রধান জাওয়াহিরি
আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি ছিলেন আল-কায়েদার মূল মতাদর্শী এবং কৌশলবিদ। তার ছিল বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবেও তাকে অভিযুক্ত করে আসছিল মার্কিন প্রশাসন।
কায়রোর মেডিসিন অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী আল-জাওয়াহিরি ছিলেন একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। তিনিই নানা ঘটনা পরিক্রমায় আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৯৮ সালে কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা, ওয়াশিংটন ডিসি এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে ৯/১১ হামলায় ৭১ বছর বয়সী মিশরীয় চক্ষু চিকিৎসকের মূল ভূমিকা ছিল। ৯/১১ তে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
২০১১ সালে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নিহত হওয়ার দুই মাস পর আইমান আল-জাহওয়াহিরিকে নেতা নির্বাচন করে আল-কায়েদা।
বিন লাদেন একটি বিশিষ্ট সৌদি পরিবারে একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পটভূমি থেকে এসেছিলেন। অন্যদিকে, আল-জাওয়াহিরির একজন ভূগর্ভস্থ বিপ্লবীর অভিজ্ঞতা ছিল। বিন লাদেন আল-কায়েদাকে ক্যারিশমা এবং অর্থ সরবরাহ করেছিলেন। কিন্তু আল-জাওয়াহিরিই কৌশল এবং সাংগঠনিক দক্ষতা এনেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির নিরাপত্তা অধ্যয়নের অধ্যাপক এবং বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিউজ এজেন্সিকে বলেন, ‘বিন লাদেন সবসময় তার (জাওয়াহিরি) দিকে তাকিয়ে থাকতেন’।
আল-জাওয়াহিরি ১৯৮১ সালে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতকে হত্যার পর আদালতের খাঁচায় দাঁড়ানোর সময় প্রথম আলোচিত হন।
ওই সময় সাদা পোশাক পড়া আল-জাওয়াহিরি চিৎকার করে বলেন, ‘আমরা ত্যাগ করেছি এবং ইসলামের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখনো আরও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি’।
ইসরায়েলের সঙ্গে মিশরের শান্তিচুক্তির কারণে আনোয়ার সাদাতের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন আল-জাওয়াহিরি। তিনি যখন আদালতে বক্তব্য দেন তখন তার সহকর্মী আসামিরা স্লোগান দিচ্ছিল।
বিন লাদেনের সঙ্গে আল-জাওয়াহিরি
আল-জাওয়াহিরি অবৈধ অস্ত্র রাখার জন্য তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন কিন্তু হত্যার মূল অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছিলেন।
আল জাহওয়াহিরি একজন প্রশিক্ষিত সার্জন ছিলেন। তার ছদ্মনাম ছিল ‘দ্য ডক্টর’। আল-জাওয়াহিরি তার মুক্তির পর পাকিস্তানে যান যেখানে তিনি সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত আফগানিস্তানে আহত মুজাহিদিন যোদ্ধাদের চিকিত্সার জন্য রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
তখনই আল-জাওয়াহিরি বিন লাদেনের সঙ্গে পরিচিত হন, যিনি আফগান প্রতিরোধে যোগ দিয়েছিলেন।
মিশর আক্রমণ
১৯৯৩ সালে মিশরে ইসলামিক জিহাদের নেতৃত্ব নেন আল-জাওয়াহিরি। তিনি ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারকে উৎখাত করার এবং একটি বিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি প্রচারাভিযানের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ওই সময় এক হাজার ২০০ জনেরও বেশি মিশরীয় নিহত হয়েছিল।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় ১৯৯৫ সালের জুনে মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে একটি হত্যা প্রচেষ্টার পর মিশরীয় কর্তৃপক্ষ ইসলামিক জিহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ধূসর, সাদা-পাগড়িধারী আল-জাওয়াহিরি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১৯৯৫ সালে মিশরীয় দূতাবাসে হামলার নির্দেশ দেন। বিস্ফোরক ভর্তি দুটি গাড়ি কম্পাউন্ডের গেট দিয়ে ঢুকে ইসলামাবাদের মিশরীয় দূতাবাসে ঢুকে পড়ে। এতে ১৬ জন নিহত হয়।
আল-জাওযাহিরি ১৯৯৭ সালে মিশরের লুক্সর শহরে বিদেশি পর্যটকদের উপর হামলার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ওই হামলায় ৬২ জন নিহত হয়েছিল।
১৯৯৯ সালে একটি মিশরীয় সামরিক আদালত আল-জাওয়াহিরির অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ততক্ষণে, তিনি বিন লাদেনকে আল-কায়েদা গঠনে সহায়তা করেছিলেন। সেই সময় বিশ্বাস করা হয়েছিল যে তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে কয়েক বছর লুকিয়ে ছিলেন।
বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল-জাওয়াহিরি পশ্চিমের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতার হুমকির কথা স্মরণ করে তিনি বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ না আমরা এটিকে বাস্তবে পরিণত করি এবং যতক্ষণ না আপনি মুসলমানদের ভূমি ছেড়ে না যান ততক্ষণ আপনি নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখবেন না’।
কিন্তু আল-জাওয়াহিরি হতাশায় চোখে দেখেছিলেন যে আল-কায়েদা ২০১১ সালের আরব বিদ্রোহের দ্বারা কার্যকরভাবে দূরে সরে গিয়েছিল। আরব বিদ্রোহ মূলত মধ্যবিত্ত কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা শুরু করেছিল। তারা কয়েক দশকের স্বৈরাচারের বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৪-২০১৯ সালে ইরাকে আইএসআইএস (ISIS) গ্রুপের উত্থান হয়েছিল এবং সিরিয়া বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
জাওয়াহিরির জন্ম ও বেড়ে উঠা
১৯৫১ সালে কায়রোর একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আল-জাওয়াহিরি। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ আল আজহারের গ্র্যান্ড ইমামের নাতি ছিলেন তিনি।
তিনি কায়রোর মাদি উপশহরে বেড়ে উঠেছিলেন। এই উপশহরে পশ্চিমা দেশের প্রবাসীদের অবস্থান ছিল। এসব পশ্চিমা প্রবাসী আল-জাওয়াহিরির বিরুদ্ধে তার কর্মকাণ্ডের জন্য সেই সময় প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন।
ফার্মাকোলজির অধ্যাপকের ছেলে আল-জাওয়াহিরিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেওয়ার জন্য ১৫ বছর বয়সে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি মিশরীয় লেখক সাইয়্যেদ কুতুবের বিপ্লবী চিন্তাধারার অনুপ্রেরণাও পেয়েছিলেন। সাইয়্যেদ কুতুবকে ১৯৬৬ সালে সরকার উৎখাত করার চেষ্টার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭০ এর দশকে কায়রো ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অনুষদে আল-জাওয়াহিরির সঙ্গে অধ্যয়ন করা সহপাঠীরা জানান, আল-জাওয়াহিরি ছিলেন একজন প্রাণবন্ত যুবক যিনি সিনেমা দেখতে যেতেন, গান শুনতেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে রসিকতা করতেন।
আল-জাওয়াহিরির সহপাঠী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তার বলেছেন, ‘যখন তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন’।
সূত্র: আল-জাজিরা টেলিভিশন
আরইউ/আরএ/