পররাষ্ট্র ও দৈন্য অর্থনীতির চাপে শাহবাজ সরকার
সম্প্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান সরকারের পতন হয়। ক্ষমতায় আসে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। তবে এ সরকারের সামনে রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতকে ইতিবাচক সংকেত দিয়েছেন। তবে এখনই এ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আবার অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। একইভাবে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তার সরকার কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
শাহবাজ শরিফ বলেন, তার সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে। একই সঙ্গে তিনি চীনের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে জোর দেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুর্বল করার জন্য ইমরান সরকারের সমালোচনা করেন। এই বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) অগ্রগতি লাভ করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শাহবাজ শরিফকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কারণ, সদ্যবিদায়ী ইমরান খানের অধীন সেই সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ইমরান প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, পেছন থেকে যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নেড়ে বিরোধী জোটগুলোর মাধ্যমে তাকে বিদায় করেছে। বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে যুক্তরাষ্ট্র তার পতনে অংশ নিয়েছে।
পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের একজন সিনেটর ও সিনেটের প্রতিরক্ষা কমিটির চেয়ারপারসন মুশাহিদ হোসেন সাঈদ বলেছেন, গত মাসে আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যা ঘটেছে, সেটি একটি সাময়িক বিপর্যয়। পূর্ববর্তী শাসনামলের শেষদিকে পাকিস্তান-আমেরিকা সম্পর্কের অবনতির দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক শান্তি, সংযোগ, সন্ত্রাসবাদ, আফগানিস্তান, জলবায়ু পরিবর্তন ও সামরিক সম্পর্কের মতো পারস্পরিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ভিত্তিতে আরও স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়তে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রকে এক হতে হবে।
চীন প্রসঙ্গে মুশাহিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শরিফ তার প্রথম কার্যদিবসে ‘চীন-পাকিস্তানের শক্তিশালী বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ অংশীদারের’ কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সিপিইসি প্রকল্প পাকিস্তানের গতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে এবং শরিফের অধীন দুই দেশের সম্পর্ক আরও জাগ্রত ও টেকসই হবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগতভাবে সামরিক সংস্থা দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে দেশটির সামরিক বাহিনী বিশেষভাবে সতর্ক থাকে। বেশিরভাগ দেশ নিরাপত্তার কারণে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া একটি বার্তায় বলেছিলেন, ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ক্ষমতা থেকে যদি বাদ না পড়ে, তাহলে এর ‘পরিণাম’ ভোগ করতে হবে।
ইমরান খান গদি হারানোর পর পাকিস্তানের রাজপথে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা মার্কিন পতাকা পুড়েছে। সামনের দিনগুলোতে তারা শরিফকে মার্কিন মদদপুষ্ট ‘পুতুল’ হিসেবেই দেখবেন।
পিটিআই সিনেটর নওমান ওয়াজির বলেছেন, শরিফ সরকার স্বল্পস্থায়ী হবে এবং সম্ভবত এই বছর নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে নতুন সরকারের উচিত আঞ্চলিক পদ্ধতি অনুসরণ করা। তাদের রাশিয়া, চীন, ইরান, মালয়েশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ইমরান খানের মার্কিনবিরোধী বক্তব্য দেশটির সেনাবাহিনীও ভালোভাবে নেয়নি। তাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। সম্প্রতি সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কের অবনতি হয়।
গত ১৪ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইমরানের মার্কিনবিরোধী তত্ত্ব খণ্ডন করে সেনাবাহিনীকে অপদস্থ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে পিটিআইকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়।
ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি চায়নি। ইমরান খান বিতর্কিত দাবি করেছেন।
এদিকে শাহবাজ শরিফ বাণিজ্যের অবনতি, বিপুল বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতিসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। দ্রুত ক্ষয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝাও তার জন্য বেশ উদ্বেগের।
পাকিস্তানের রাজস্ব ঘাটতিও দিনে দিনে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। আর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছয় শতাংশের কিছুটা বেশি হতে পারে। আগের সরকারের আমলেও ঠিক এই হিসাব করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি রাজস্ব বছরে তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে বলে দাবি করা একটু অতিরিক্তই হয়ে যাবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমান অর্থবছরে পাকিস্তানের বাহ্যিক অর্থায়ন পরিচিত উৎসগুলো থেকেই পুরোপুরি পূরণ করতে হবে।
দেশটির অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ যে অর্থনীতি পেয়েছিল, বর্তমানে তা আরও খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। এই ঘটনাকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। আগের সরকার তৃতীয় দফায় ধনীদের কর মওকুফ করায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দিতে বিলম্ব করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা।
চীনও আড়াইশ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেও সময় নিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যখন প্রত্যাশামতো ফিরে আসে, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছে অঙ্গীকার রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেন মিফতাহ ইসমাইল। চীনও সাহায্যের হাত বিস্তৃত করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতিকে জোরালোভবে পুনরুজ্জীবিত করতে পাকিস্তানের নতুন শাসকেরা বড় কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে কিনা। তা নিশ্চিত করতে হলে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় আরও সম্প্রসারিত করতে হবে, ক্ষমতাবানদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। তাদের কাছ থেকে যথাযথভাবে কর আদায় করতে হবে। ধনীরা যাতে কর না দিয়ে রেহাই পেয়ে না যান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতে স্টিল মিল ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণ করতে হবে। রফতানি চাঙ্গা করাসহ আমদানির অর্থ পরিশোধের জন্য উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়াতে শাসন ও নীতিগত সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে। এসব রাজস্ব ও উৎপাদনশীলতা সংস্কারে জোট সরকারের হাতে খুব সময়ও নেই। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ীভাবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাঠামোগত পরিবর্তনে এই সরকারকেই হাত দিতে হবে।
এ সরকারের সফলতা নির্ভর করবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নিপীড়নের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা না আসার উপর। বিভিন্ন সেবামূলক খাতে ভর্তুকি কীভাবে বিন্যাস করা হবে, এর অর্থের জোগান কীভাবে আসবে–এসব বিষয় শাহবাজ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। যা এ সরকারের টিকে থাকা না থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এসএ/