ডনবাস ঘেরাও করে ফেলছে রাশিয়া
ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর রাজধানী কিয়েভ ঘিরে রেখেছিল রুশ বাহিনী। পরে সেখান থেকে সেনাদের পূর্ব ইউক্রেনে সরিয়ে নেওয়া হয়। এখন ডনবাস অঞ্চলকে ঘিরেই রাশিয়া পুরো যুদ্ধের রণকৌশল সাজিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ বহুদিন ধরে চলতে পারে। ইতিমধ্যে মারিউপোল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পুতিন যখন ডনবাসের কথা বলেন, তখন তিনি ইউক্রেনের কয়লা ও ইস্পাত উৎপাদনকারী অঞ্চলের কথাও উল্লেখ করেন। পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ দুটো অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্কও এর অংশ। দক্ষিণের মারিউপোল বন্দর থেকে শুরু করে উত্তরে রুশ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি।
ব্রিটিশ সংসবাদমাধ্যম বিবিসির জানায়, এখনও সেখানে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পরাজয় ঘটেনি। তারা শক্তভাবে টিকে আছে। ইউক্রেনের সবচেয়ে সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীগুলো ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। কারণ গত আট বছর ধরে সেখানে রুশপন্থীদের সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে।
যুদ্ধে কিয়েভের সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলেও রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘প্রতি মিটার জমির জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মতে, এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে দোনেৎস্ক থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত দক্ষিণ উপকূলে একটি স্থল করিডোর স্থাপন করতে চায় রাশিয়া। ব্রিটেনে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের স্যাম ক্র্যানি-ইভান্স বলেন, ‘অঞ্চলটিকে রুশভাষীদের অংশ বলে শনাক্ত করেছে ক্রেমলিন। যার অর্থ এই অঞ্চলের অধিকার ইউক্রেনের চেয়েও অনেক বেশি রাশিয়ার।‘’
পোল্যান্ডের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোচান কনসাল্টিংয়ের প্রধান কনরাড মুজাইকা বলেন, ‘মারিউপোল একসময় ছিল ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি রুশপন্থী শহরগুলোর একটি। এটি এমন মাত্রায় ছিল, যা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। তবে এখনকার অবস্থা ভিন্ন।’
দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর রাশিয়ার দাবি, তারা লুহানস্কের ৯৩ শতাশ ও দোনেৎসকের ৫৪ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এখন পুরো অঞ্চল দখলে নিতে হলে রুশ প্রেসিডেন্টকে আরও লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তিনি যদি একসময় বিজয় অর্জনও করেন, তখনও ওই বৃহৎ অঞ্চলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে না।
পুতিন বারবার অভিযোগ করেছেন, ইউক্রেন পূর্বাঞ্চলে গণহত্যা চালিয়েছে। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন পূর্বদিকের এসব অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ইউক্রেনের হাতে। বাকি অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করতো। আট বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থনে সেখানে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বিদ্রোহীরা।
ইতিমধ্যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছেন পুতিন। রাশিয়া যদি এই দুটো বৃহৎ অঞ্চল জয় করতে পারে, পুতিন তাহলে দেখাতে পারবেন যে, এই যুদ্ধ থেকে তিনি কিছু একটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ডনবাসকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করে নেওয়া। ২০১৪ সালে বিতর্কিত এক গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে তিনি ঠিক যেভাবে রাশিয়ার অংশ করে নিয়েছেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ১০টি ব্রিগেড নিয়ে জয়েন্ট ফোর্সেস অপারেশন নামে যে বাহিনী গঠন করা হয়েছে, তাতে দেশটির সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সৈন্যরা রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ২১ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশপন্থী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের দুই অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। সেখানে ‘শান্তি রক্ষায়’ সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। এরপর উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। একই সঙ্গে ‘প্রজাতন্ত্র’ দুটিতে রুশ সেনাদের ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি। পুতিনের এই পদক্ষেপের পর পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে দিয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত ডনবাস অঞ্চলে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ইউক্রেনের ওই অঞ্চলে গত আট বছরের লড়াইয়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।
৫০ দিনের যুদ্ধে ইউক্রেনের একাংশ এখন রাশিয়ার দখলে। আজ চলছে যুদ্ধের ৫১তম দিন। ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো বা অন্য কোনো পশ্চিমা শক্তিধর দেশ সামরিক হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসেনি।
এসএ/