খাদ্য সংকট বিক্ষোভ ঠেকাতে কারফিউ জারি শ্রীলঙ্কায়
বিক্ষোভ ঠেকাতে জরুরি অবস্থার মধ্যেই এবার কারফিউ জারি করলো শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত দেশটিতে খাদ্য, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলছে। এই বিক্ষোভ ঠেকাতেই ৩৬ ঘন্টার কারফিউ দিল শ্রীলঙ্কা।
৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করে তার বাসভবন ভাঙচুর চালানোর পর ওই রাতে শুধুমাত্র রাজধানী কলম্বোয় কারফিউ ঘোষণা করা হয়। পরদিন শুক্রবার ( ১ এপ্রিল) সকালে সেই কারফিউ তুলে দেওয়া হয়।
শুক্রবার বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে নারীসহ ৫৩ জনকে আটক করে দেশটির পুলিশ। এদের মধ্যে পাঁচজন ফটো সাংবাদিক রয়েছেন।
ওই বিক্ষোভের পর থেকেউ সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে শ্রীলঙ্কা সরকার। কোন প্রকার ওয়ারেন্ট ছাড়াই সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে।
বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন পার করছে দেশটি। দেশটি জ্বালানি আমদানিতে বড় আঙ্কের অর্থ ব্যায় করায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকটে পড়েছে।
শুক্রবার (১ এপ্রিল) সর্বজনীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে একটি গেজেট প্রকাশ করেছেন। জরুরি অবস্থার ঘোষণার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায় কড়া আইন কার্যকর করেছেন গোটাবায়া, যে আইনের আওতায় বিচার ছাড়াই যে কোনও ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন আটকে বা গ্রেফতার করে রাখার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে সেনাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, বিক্ষোভকারীদের দমন করতে আদতে সেনার হাতে লাগামছাড়া ক্ষমতা তুলে দেওয়া হল। সেই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হবে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট মহল।
যদিও একটি ঘোষণাপত্র জারি করে গোটাবায়ার সাফাই দিয়েছেন যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বা পরিষেবা প্রদানের জন্য জরুরি অবস্থার ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় প্রতিদিন ১৩ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেখা দিচ্ছে। জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধ সংকটের কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ চরমে। এই সংকটের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ শুরু হয়।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বিদেশি মুদ্রার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। দাম পরিশোধ করতে না পারায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সিমেন্ট পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। লোকজনকে জ্বালানির জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১৩ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে। কাগজের অভাবে স্কুলের পরীক্ষা ও দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সংকটে এমনকি সড়কবাতিও বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান বিভাগ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এক আগের তুলনায় মার্চ মাসে খুচরো মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০.২ শতাংশ ছুঁয়েছে। ফার্স্ট ক্যাপিটাল রিসার্চের গবেষণা প্রধান দিমান্থা ম্যাথিউ বলেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে।
শ্রীলঙ্কার দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের অনেকের কাছেই অভাব নতুন কিছু নয়। ১৯৭০-এর দশকে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের সময়ে দেশটির কর্তৃপক্ষ রেশন বই ইস্যু করে। এর মাধ্যমে চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। তবে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে, বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের জন্য বর্তমানে প্রচলিত রেশনিং ব্যবস্থা স্থানীয়দের কাছে ঠাট্টার বিষয় হয়ে উঠেছে।
কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধ শেষে ২০০৯ সালের পর শ্রীলঙ্কা যখন অর্থনৈতিকভাবে জেগে উঠতে শুরু করে তারপর থেকে একাধিক দুর্ভাগ্য দেশটিকে আঘাত করেছে। ২০১৬ সালে কৃষকরা ভয়াবহ খরার মুখে পড়েন। তিন বছর পর ইস্টার সানডেতে বোমা হামলায় অন্তত ২৭৯ জন নিহত হয়। এর জেরে বিদেশি পর্যটকেরা শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ বাদ দিতে শুরু করে। এর জের না কাটতেই করোনা মহামারির আঘাতে পর্যটন শিল্প একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে শ্রীলঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। অথচ বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং আমদানির মূল্য পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন।
কলম্বোভিত্তিক থিংক ট্যাংক অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মুর্তজা জাফারজি বলেন, এসবের চেয়েও বড় সমস্যা ছিল সরকারের অব্যবস্থাপনা। টানা কয়েক বছরের ঘাটতি বাজেট, মহামারি শুরুর আগে অদূরদর্শী ট্যাক্স কমানোয় সরকারের রাজস্ব আয় দ্রুত কমতে থাকে। আর বিদ্যুৎ এবং অন্য সেবায় দেওয়া ভর্তুকি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বণ্টন হওয়ায় লাভবান হয় ধনীরা।
দুর্বল নীতিগত সিদ্ধান্তে সমস্যা বেড়েছে। গত বছর কর্মকর্তারা ঘোষণা দেন, বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অর্গানিক কৃষির দেশ হবে শ্রীলঙ্কা। রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া হয় সার আমদানি। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। সার আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা মাঠ খালি রাখতে বাধ্য হয়। ফলে কয়েক মাস পর সরকার বাধ্য হয়ে ওই নীতি বাতিল করে।
শ্রীলঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা চাইছে। কিন্তু আলোচনা শেষ হতে এই বছরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত লাগতে পারে। আর মানুষ সামনে আরও কঠিন সময়ের অপেক্ষায় আছেন। মুর্তজা জাফারজি বলেন, 'আমি আরও অনেক খারাপের আশঙ্কা করছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, যারা এই সমস্যা তৈরি করেছে তারা এখনও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে।'
কেএফ/