ইউক্রেন সংকট: প্রশ্নবিদ্ধ পশ্চিমা ‘নিরপেক্ষ’ সাংবাদিকতা
রুশ সৈন্যরা ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে প্রবেশ করে। এরপর পশ্চিমা সংবাদদাতারা এবং ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে নিউজরুম রাশিয়ার অহিংস আগ্রাসনে ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অতিমাত্রায় সহানুভূতি দেখান। সেই সঙ্গে নিজ দেশকে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরেন তাদের প্রতি উল্লেখযোগ্য সহানুভূতিও দেখান।
আক্রমণের প্রথম দিকে, সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে ইউক্রেনীয়রা প্রতিদিন যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয় ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায়। ধীরে ধীরে ‘প্রতিরোধ’ শব্দটি ইউক্রেনীয় সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবকদের বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যারা তাদের স্বদেশ রক্ষার জন্য অস্ত্র ধরেছেন। পশ্চিমা চ্যানেল এবং নিউজসাইটগুলো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিরি জেলেনস্কির বার্তা প্রচার করে। যেখানে প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনীয়দের দেশের ভেতরে এবং বাইরে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। তিনি যে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের কাছে সামরিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেন তাও প্রচার করা হয়।
সংবাদ প্রতিবেদনে, রাশিয়ার তথাকথিত ‘বিশেষ অভিযান’ কে বারবার একটি ‘আক্রমণ’, এবং ‘অপ্ররোচনাহীন আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু’ এবং ‘আবাসিক এলাকায় গোলাবর্ষণের’ জন্য নিন্দা করা হয়েছে। ‘বেসামরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে’ এই ভিত্তিহীন দাবি ছাড়া রাশিয়াকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।
যুদ্ধ কাভার করা একজন সাংবাদিক হিসেবে, ইউক্রেনের যুদ্ধের কাভারেজের জন্য এই শর্তাবলী সমর্থন করা যায়। সাংবাদিকরা এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যা তাদের চোখের সামনে একটি উদীয়মান পরিস্থিতির বাস্তবতাকে সঠিকভাবে প্রকাশ করে– যে ভাষা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখেও ‘উদ্দেশ্য’, ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার ইচ্ছা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা স্টাডিজ বিভাগের প্রধান জাহেরা হার্ব বলেন, রাশিয়ান আগ্রাসনের সুযোগে এই জাতীয় সুনির্দিষ্ট ভাষা এবং পরিভাষা ব্যবহারকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করা গেলেও এক্ষেত্রে হতবাক এবং হতাশ হতে হয়। কারণ পশ্চিমা মিডিয়ার জন্য ১৯৯০ এর দশকে লেবাননে ইসরায়েলের ‘আক্রমণ’ কাভার করার সময়ে, দেশে কী ঘটছে তা সঠিকভাবে বর্ণনা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেসময় সাংবাদিকদের ওই দ্বন্দ্বের কাভারেজের ক্ষেত্রে ‘আবেগপ্রবণ’, ‘আংশিক’ বা ‘ভারসাম্যহীন’ হওয়ার জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। যখনই তারা যা বলার চেষ্টা করে, শ্বেতাঙ্গ, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সংবাদর্মীরাও পক্ষপাতিত্ব এবং বস্তুনিষ্ঠতার অভাবের অভিযোগের সম্মুখীন হন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে, প্রবীণ ব্রিটিশ সাংবাদিক জন স্নো চ্যানেল-৪ নিউজ ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায় বহু নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তিনি ইসরায়েলকে নৃশংস দমন-পীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একাধিক সমালোচনা এবং এমনকি নিন্দার সম্মুখীন হন। স্নোর ভিডিওটি দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় এবং জনসাধারণের অনেকেই তাকে ইসরায়েলের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে সঠিকভাবে রিপোর্ট করার জন্য অভিনন্দন জানান। বেশিরভাগ সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষক ব্রিটিশ সাংবাদিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতার নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে তার সমালোচনা করেন।
যখন আমরা ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং অন্যান্য পশ্চিমা চ্যানেলগুলোতে ইউক্রেনের যুদ্ধের চলমান কাভারেজ দেখি এবং সাংবাদিকদের সহানুভূতি, আবেগ এবং মানবতা প্রদর্শন করতে দেখি, যখন তারা তাদের চোখে দেখা নৃশংসতার বিষয়ে রিপোর্ট করে তখন আমাদের প্রশ্ন করা উচিত যে বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষতা মানে সত্যিই কী সাংবাদিকতা।
পশ্চিমা সাংবাদিকরা আর উচ্চতর নৈতিক ভিত্তি দাবি করতে পারে না – তারা আর বলতে পারে না যে তারা গ্লোবাল সাউথের সাংবাদিকদের চেয়ে কিছুটা ভাল, আরও পেশাদার।
প্রতিটি একক পশ্চিমা সাংবাদিক যারা ইউক্রেন যুদ্ধের কাভারেজের জন্য অবদান রেখেছেন এবং ‘প্রতিরোধ’, ‘আগ্রাসন’ এর মতো শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের থামতে হবে এবং ভাবতে হবে কেন লেবাননের সাংবাদিকদের জন্য একই শব্দ ব্যবহার করা অগ্রহণযোগ্য। যেখানে ১৯৯৩, ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে লেবাননের বেসামরিক নাগরিকদের উপর ইসরায়েল হামলা করে।
তাদের থামতে হবে এবং জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন লেবাননের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি, তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখানো, তাদের সংগ্রাম ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টাকে পক্ষপাতিত্ব এবং অ-পেশাদারিত্ব হিসেবে দেখা হয়।
অতীতে লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার কাভারেজে যখন লেবাননের সাংবাদিকদের ‘প্রেক্ষাপটে উদ্দেশ্যমূলক’ বলে লেখা হয়, তখন বলা হয়েছিল যে ‘প্রসঙ্গে উদ্দেশ্য বলে কিছু নেই’। কিন্তু এখন অ্যাংলো-আমেরিকান সাংবাদিকরা তাদের ইউক্রেনের কাভারেজের ক্ষেত্রে ‘প্রেক্ষাপটে উদ্দেশ্যমূলক’ হয়ে উঠছে । তারা তাদের নিজস্ব অনুভূতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস প্রচার করছে।
অনেক দীর্ঘ সময় ধরে, পশ্চিমা সাংবাদিকরা এবং শ্রোতারা বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতাকে পরম ধারণা হিসেবে দেখেছেন।
এর মধ্যে, ইউক্রেনের চলমান ট্র্যাজেডি কাভার করার জন্য কিছু পশ্চিমা সাংবাদিকের প্রশংসনীয় কাজকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উদ্বাস্তুদের সংজ্ঞায়িত করার সময় কিছু সাংবাদিকের বর্ণবাদী, প্রাচ্যবাদী এবং অবমাননাকর অনুভূতি বাদ দিয়ে, বেশিরভাগ সংবাদকর্মী তাদের দর্শকদের কাছে বর্তমানে ইউক্রেনে যা ঘটছে তা সঠিকভাবে জানাতে কাজ করেছেন।
মানসম্পন্ন সাংবাদিকতার জন্য পরম বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতা সবসময় প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের দুর্দশা এবং কষ্টের সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় তা ভালো, সঠিক এবং অর্থপূর্ণ সুযোগের জন্য বাধা হতে পারে। একটি মানব ট্র্যাজেডিকে কাভার করার সময় নিরপেক্ষতার অর্থ এবং গুরুত্ব পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে – তা বন্ধু হোক বা শত্রু।
ন্যাটোর আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ায় প্রতিবেদন নেই। ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা কেন বাড়ানো হচ্ছে তারও ব্যাখ্যা কেউ দিচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেন যখন ন্যাটোর সদস্য হতে মরিয়া তখন রাশিয়া যে ইউক্রেনকে ছাড় দেবে না তা অনুমেয়ই ছিল। বুকের উপর পশ্চিমাদের আধিপত্য কখনোই মানবে না রাশিয়া। পশ্চিমা মিডিয়ায় এ বিষয়গুলো সব সময় উপেক্ষিত। তথ্যসূত্র: আল জাজিরা
আরএ/