গাজায় হামলা চালিয়ে যেতে ইসরায়েলি সেনাদের অস্বীকৃতি
গাজায় হামলা চালিয়ে যেতে ইসরায়েলি সেনাদের অস্বীকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিরস্ত্র এক ফিলিস্তিনি কিশোরের হত্যার দৃশ্যটি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ইয়োতাম ভিল্ক। গাজায় ১৫ মাসের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তিদের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারাও আছেন। তাঁদেরই একজন ভিল্ক।
ভিল্কের তথ্যানুসারে, গাজায় ইসরায়েল–নিয়ন্ত্রিত বাফার জোনে অননুমোদিত ব্যক্তি প্রবেশ করলেই তাঁকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া আছে। তিনি কমপক্ষে ১২ জনকে এভাবে হত্যার শিকার হতে দেখেছেন। তবে ওই কিশোরকে হত্যার দৃশ্যটি এখনো তাঁর চোখের সামনে ভাসছে।
এসব ইসরায়েলি সেনা ইতিমধ্যে গাজায় লড়াই চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে সেনারা বলেন, তাঁরা এমন কিছু দেখেছেন বা করেছেন, যা নৈতিকতার সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গেছে।
ইসরায়েল ও হামাস গতকাল বুধবার একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে আগামী রোববার থেকে।
অবশ্য এই অগ্রগতির আগেই কিছুসংখ্যক ইসরায়েলি সেনা যুদ্ধ বন্ধের জন্য তৎপরতা শুরু করেন। যেমন প্রায় ২০০ ইসরায়েলি সেনা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সরকার যদি যুদ্ধবিরতিতে না পৌঁছায়, তবে তাঁরা লড়াই করা বন্ধ করে দেবেন। একে ‘সূচনাপর্ব’ বলে উল্লেখ করা হয়।
গাজায় লড়াই চালিয়ে যেতে রাজি না হওয়া ইসরায়েলের সাত সেনাসদস্য বার্তা সংস্থা এপির সঙ্গে কথা বলেন। ফিলিস্তিনিদের কীভাবে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে, তা বর্ণনা করেছেন তাঁরা।
তবে সময় যত গড়াতে থাকে, তত বেশি মতভেদ দেখা দিতে থাকে। তবে সমালোচনাগুলোর বেশির ভাগই নিহত সেনার সংখ্যা বাড়তে থাকা, জিম্মিদের বাড়িতে ফেরাতে ব্যর্থ হওয়াসংক্রান্ত। গাজার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া–সংক্রান্ত নয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও জাতিহত্যা (জেনোসাইড) চালাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা জাতিহত্যার অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
জাতিহত্যা চালানোর অভিযোগগুলো দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। তাদের দাবি, গাজায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তারা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষদের ওপর হামলা চালায়নি। কোনো ভুলত্রুটি হয়েছে বলে সন্দেহ হলে তা তদন্ত করা হয়, শাস্তি দেওয়া হয়।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজেরাই এসবের তদন্ত করছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এপিকে বলেছে, সেনাদের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতির নিন্দা জানায় তারা। কেউ দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়। ব্যক্তিপর্যায়ে প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা হয়।
দায়িত্ব পালন না করতে চাইলে সেনাদের কারাগারে যেতে হতে পারে। তবে এই স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচির আয়োজকেরা বলেন, চিঠিতে সই করা কোনো সেনাকে এখন পর্যন্ত আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ভিল্ক গাজায় ঢোকেন। এই ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা বলেন, তিনি ভেবেছিলেন, প্রাথমিকভাবে বল প্রয়োগ করে দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসানো যাবে। কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হতে থাকল, তিনি ততই দেখতে থাকলেন যে মানুষের জীবন কতটা মূল্যহীন।
ভিল্ক বলেন, গত বছরের আগস্টে ওই ফিলিস্তিনি কিশোর নিহত হয়। সেদিন ইসরায়েলি সেনারা ওই কিশোরকে থামতে বলেছিলেন। সতর্ক করতে তার পায়ে গুলি করা হয়েছিল। তবু ওই কিশোর থামছিল না। নেতজারিম করিডরের বাফার জোনে দিকে হেঁটে আসা অন্যদেরও গুলি করা হয়।
নেতজারিম করিডর হলো গাজার উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলকে বিভক্তকারী সড়ক। ভিল্ক স্বীকার করেন, লোকজনের কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না, তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে তিনি মনে করেন, ইসরায়েলি সেনারা অনেক বেশি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেন।
বাফার জোনে কিছু প্রাণহানির জন্য হামাসও দায়ী বলে উল্লেখ করেন ভিল্ক। তিনি বলেন, তাঁর সেনা দলের হাতে আটক হওয়া এক ফিলিস্তিনি নাগরিকের কাছ থেকে শুনেছিলেন, ওই করিডর দিয়ে ঢোকার জন্য হামাস লোকজনকে ২৫ ডলার করে দিত। এর মধ্য দিয়ে হামাস ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বোঝার চেষ্টা করত।
ইসরায়েলি সেনাদের কেউ কেউ এপিকে বলেন, গাজা উপত্যকায় তাঁরা যা দেখেছেন, তা হজম করতে তাঁদের সময় লাগবে। অন্যরা বলেছেন, তাঁরা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তাৎক্ষণিকভাবে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক চিকিৎসাকর্মী ইয়ুভাল গ্রিন বলেন, গাজায় প্রায় দুই মাস কাটানোর পর গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যা দেখছিলেন, তা মেনে নিতে পারছিলেন না বলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।