অমিক্রনে হেলাফেলা; সংক্রমণের বিদ্যুৎগতি
রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের কম্পিউটার ব্যবসায়ী ফরিদ আলম। জ্বর, ঠান্ডা, কাশিতে ভুগছেন। তিন দিন আগে জ্বর ছিলো। এখন নেই। সর্দিও কিছুটা কেমেছে। কিন্তু জ্বর বলে বাড়িতে থাকেননি। একদিন বাড়িতে থেকেই চলে এসেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মানিক চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। জ্বর, ঠান্ডা কাশি নিয়েই চলছেন তিন দিন ধরে। বলেন তেমন কিছু না; ঠান্ডা লেগেছে। জাহিদ চাকরি করেন হাউজিং কোম্পানিতে। রাতে হালকা জ্বর আসায় নাপা খেয়ে সকালে অফিসে চলে গেলেন। বিকাল থেকে নাক দিয়ে পানি ঝড়ছে, আর হালকা কাশি। কিন্তু তাতে কিছু মনে করছেন না। বলেন, শীতে এমন হয়ই।
বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দাপট দেখাচ্ছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন। প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) মোট ১৬ হাজার ৩৩ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পরেছে। এ সময় মারা গেছেন ১৮ জন। শনাক্তের হার ৩২ দশিমিক ৪০।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অমিক্রন শনাক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। করোনা ইনফো ওয়েব সাইটের তথ্য মতে, গত এক মাসে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৬ জন শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন ২১৪ জন। আর গত ৭দিনে দেশে নতুন শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯০৪ জন। আর এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১৫৮ জনের। সুতরাং একথা সহজেই বোঝা যাচ্ছে ৬ ডিসেম্বরের তুলনায় এক মাস পর সংক্রমণের তীব্রতা কতটুকু বেড়েছে। যেভাবে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে নতুন এই ঢেউয়ে ভাইরাসটি বিদ্যুতের গতিতেই ছড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা সংস্থা (আইসিডিডিআর'বি) গত ২০ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিদেনে বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকায় জানুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্ততের ৬৯ শতাংশ শরীরে অমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অন্ততপক্ষে অমিক্রনের তিনটি সাব-টাইপ ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি অধিক সংবেদশীল। যে কারণে এর বিস্তার ঘটছে দ্রুত। যেটা অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তবে আশার জায়গা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্টটি প্রাণঘাতি নয়। এ কারণে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম।
অমিক্রণের লক্ষণ:
চিকিৎসকদের মতে, অমিক্রন অনেকের কাছে সাধারণ ঠান্ডার মতোই মনে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পর গলা শুকিয়ে যাওয়া, সর্দি লাগা, শরীরের জয়েন্টে ব্যাথা বা মাথা ব্যাথা হতে পারে। সাথে হালকা জ্বর। আক্রান্তের কাছ থেকে মূলত এসব লক্ষণ জানাগেছে।অনেকের ক্ষেত্রে ফুসফুসের উপরি অংশ ব্যাথা হচ্ছে।শরীর ক্লান্ত লাগছে বলে জানাচ্ছেন রোগীরা।
এসবের তোয়াক্কা করে কি আমাদের দেশের মানুষ? শিক্ষিত সচেতনদের মধ্যেও সাধারণ সর্দি কাশিকে তোয়াক্কা করতে দেখো যায় না। আর যার খেটে খাওয়া মানুষ তারা এসব সাধারণ ঠান্ডা কাশিকে বা হালকা জ্বরকে পাত্তা দেওয়ার সময় কোথায়? ফলে অধিক সংবেদনশীল অমিক্রমন আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে। রাজধানীর বাইরে কোনো কোনো এলাকায় সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
এছাড়া অমিক্রণের উপসর্গ হালকা বলে অনেকেই পরীক্ষা করানোর প্রয়োজনও অনুভব করছেন না। কারণ ৪-৫দিন পর সর্দি, জ্বর কাশি আপনা আপনি ভালো হয়ে যাচ্ছে। আর ভালো হলেই কাজে ফেরা যাচ্ছে। যেহেতু পরীক্ষা নেই, আইসোলেশনের বেরিয়ারও নেই বলেই তারা মনে করছেন। সংক্রমনের গতি বেশি হওয়ার এটাও উল্লেখযোগ্য কারণ।
অমিক্রনে আক্রান্তরা কতদিন অন্যের জন্য বিপদজনক:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন দেশের সরকারকে সতর্ক করেছে অমিক্রনকে কোনোভাবেই হেলাফেলা করা উচিৎ হবে না। বিশেষ করে যাদের এখনও ভ্যাকসিন হয়নি তারা এই ভাইরাসে মারা যেতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, অমিক্রনের উপসর্গ তিনদিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা গড়ে পাঁচদিন।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছেন করোনাভাইরাসের রোগীরা আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক হন। অমিক্রনের ক্ষেত্রে, আক্রান্ত রোগীর শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার একদিন বা দুদিন আগেই সে অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। আর উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর দুই থেকে তিনদিন পর্যন্ত সে অন্যের জন্য ঝুঁকি থাকবে।
অর্থাৎ কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়ার পর তিন থেকে পাঁচদিন সে অন্য যে কাউকে সংক্রামিত করতে পারে। অমিক্রন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সাতদিনের মত থাকে। ফলে, শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর বড়জোর সাতদিন কোনো রোগী অন্যের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
আইসোলেশন কত দিন
আইইডিসিআর এর হটলাইনের চিকিৎসকের মতে, সর্দি, জ্বর বা হালকা কাশির মতো উপসর্গগুলো চারদিনের মধ্যে ভালো হয়ে গেলে টেস্ট না করালেও চলে। কারণ টেস্ট সঠিক ফল পেতে উপসর্গ দেখা দেয়ার চার দিন পর টেস্ট করালে ঠিক ফলাফল পাওয়া না। আর চার দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলে উপসর্গ দেখা দেয়ার দিন থেকে ১০দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। তা না হলে জীবানু অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
তবে যাদের কমপক্ষে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া আছে তাদেরকে অমিক্রনে আক্রান্ত হলেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে হচ্ছে না বা তাদের মৃত্যু ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ বেশ কিছু দেশে আক্রান্ত রোগীর বাধ্যতামূলক আইসোলেশন বা ঘরে আলাদা হয়ে থাকার সময়সীমা পাঁচদিনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিকদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন করোনা সংক্রমিতদের আইসোলেশন ১০ দিনের পরিবর্তে ৫ থেকে ৭ দিন করা হচ্ছে। খুব শিগগির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন আইসোলেশন নীতি ঘোষণা দেবে।