শোবিজে দ্বন্দ্বের বছর
এ বছর শোবিজ অঙ্গন বিশেষ করে চলচ্চিত্রাঙ্গনে সফলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বছর শেষে হিসেব কষতে গেলে সেই সফলতাকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বেশ কিছু ঘটনা। অভিনেতা, অভিনেত্রী ও পরিচালকরা বছর জুড়েই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল একে অপরের সঙ্গে। সেই দ্বন্দ্বের কথাই ঢাকাপ্রকাশ-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
নিপুণ বনাম জায়েদ খান
চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার ও জায়েদ খানের তুমুল দ্বন্দ্ব বছর জুড়েই ছিল আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। সেই দ্বন্দ্বের মাত্রা এত বেশি তীব্র হয় যে, একে অপরের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। তাদের দ্বন্দ্বের শুরুটা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে। গত ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২২-২৪ দ্বিবার্ষিক নির্বাচন। এতে সাধারণ সম্পাদক পদে নিপুণ ও জায়েদ খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এবারের নির্বাচনে সভাপতি পদে অভিনেতা মিশা সওদাগর এবং সাধারণ সম্পাদক পদে চিত্রনায়ক জায়েদ খান একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলে সভাপতি পদে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন এবং সাধারণ সম্পাদক পদে চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার নির্বাচন করেন।
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে জায়েদ খানের কাছে ১৩ ভোটে হারের পর ফলাফলে অসন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী নিপুণ। তার আপিলের ভিত্তিতে ভোট পুনর্গণনাতেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে জায়েদ খানকে। ৩০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে এসে ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলেন নিপুণ। সাধারণ সম্পাদক পদে ফের নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তার এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন তার পরিষদও (কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ)।
৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আপিল বোর্ডের বিশেষ জরুরি সভা শেষে জায়েদ খানের প্রার্থিতা বাতিলের ঘোষণা দেন সোহানুর রহমান সোহান। সেই সঙ্গে নিপুণ আক্তারকে ২০২২-২৪ দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেন। এরপর পদ ফিরে পেতে আদালতে মামলা করেন জায়েদ খান। সাধারণ সম্পাদকের পদে গত ২ মার্চ জায়েদ খানের পক্ষে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর শপথ নিয়ে চেয়ারেও বসেছিলেন তিনি। তবে গত ৬ মার্চ শুনানি শেষে জায়েদ খানকে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার আদালত।
অবশেষে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২১ নভেম্বর নিপুণের লিভ টু আপিল আদালত গ্রহণ করে সাধারণ সম্পাদক পদে নিপুণের দায়িত্ব পালনে আর বাধা নেই বলে ঘোষণা দেন। বর্তমানে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে নিপুণ পালন করলেও জায়েদ ও নিপুণের শীতল যুদ্ধ আজও কমেনি বিন্দুমাত্র।
অপু বিশ্বাস বনাম বুবলী ও শাকিব
ঢাকাই সিনেমার দুই জনপ্রিয় নায়িকা অপু বিশ্বাস ও শবনম বুবলি। দুজনেই চিত্রনায়ক শাকিব খানের স্ত্রী। একজন সাবেক, অন্যজন বর্তমান। দুজনই শাকিব খানের সন্তানের মা হয়েছেন। কিন্তু তাদের দুজনের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। কেউ কারো সঙ্গে কথাও বলেন না।
বুবলির জন্মদিনে ফেসবুকে জানান, তাকে নাকি শাকিব খান হীরার একটি নাকফুল উপহার দিয়েছেন। এমন নিউজ অপু বিশ্বাস শেয়ার করে ফেসবুকে লিখেন, ‘কী যে মজা’।
অপু বিশ্বাসের খোঁচা মারার পর দিনই ২৩ নভেম্বর সকালে শবনম বুবলি তার ফেসবুকে লিখেন, ‘একজন হঠাৎ করেই বলে উঠল, ‘আরে ওই বেটি যে আপনাদের ছবিসহ নিউজ তার নিজের ফেইসবুক ওয়ালে বাঁধাই করে রাখছে। এটাই তো আপনার মজা, তার শয়নে স্বপনে শুধুই আপনি। হাহাহা।’
এরপর শাকিব গণমাধ্যমে জানান তিনি বুবলিকে নাকফুল উপহার দেননি। এরপর বুবলি ফেসবুক লাইভে এসে এসবের ব্যাখ্যা দেন।
পরীমণি বনাম বিদ্যা সিনহা মিম
ঢাকাই সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা পরীমণি ও বিদ্যা সিনহা মিম। এবার এবছর এই দুই নায়িকা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। শুধু তাই নয় একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তাক করেছেন প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে।
৯ নভম্বের দিবাগত রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন পরীমণি। ফেসবুকে মিম-রাজ-রায়হায় রাফির নাম উল্লেখ করে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসে পরীমণি নির্মাতা রায়হান রাফিকে ‘দালাল’ বলে উল্লেখ করেন। মিমের উদ্দেশে করে লেখেন, ‘নিজের জামাইকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত ছিল।’ রাজের উদ্দেশে লেখেন, ‘এটা এতদূর গড়াতে দেওয়া উচিত হয়নি।’
এরপর স্ট্যাটাসটি নেট দুনিয়ায় মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। মিমের সঙ্গে পরীমণির স্বামী শরিফুল রাজের সম্পর্কে বিরক্ত হয়েই এভাবে মুখ খুলেন পরী।
মূলত ‘পরাণ’ সিনেমা সফলতা পাওয়ার পর শরীফুল রাজ ও মিমের সর্ম্পক নিয়ে আলাদা চর্চা শুরু হয় সিনেমাপাড়ায়। ‘দামাল’ সিনেমা মুক্তির আগে প্রচার অনুষ্ঠান নিয়ে ১৩ অক্টোবর ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন পরীমণি। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘সিয়ামকে সিনেমার বাইরে কোনো নায়িকার হাত ধরে চটকা-চটকি করতে দেখি নাই কোনোদিন। তার এই ব্যাপারটা আমার হেব্বি লাগে।’ পরীর এই স্ট্যাটাসের পর ১০ নভম্বের দুপুরে কড়া হুঁশয়ারি দেন মিম।
নিজের ফেসবুকে মিম জানান, প্রমাণ ছাড়া কোনো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তাকে নিয়ে করা হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন। দুই নায়িকার এই দ্বন্দ্বের অবসান এখনো হয়নি। এরইমধ্যে মিম ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আর পরীমণির স্বামী শরিফুল রাজের সঙ্গে কোনো সিনেমায় অভিনয় করবেন না।
দীঘি বনাম রায়হান রাফী
চিত্রনায়িকা প্রার্থনা ফারদিন দীঘি ও নির্মাতা রায়হান রাফির দ্বন্দ্ব এখন চরমে। নিজের অফিসে ডেকে মৌখিকভাবে সিনেমার জন্য চূড়ান্ত করেও সিনেমা থেকে দীঘিকে বাদ দিয়েছেন রাফি। এমন অভিযোগ করেন দীঘি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে দীঘি লেখেন, একজন তরুণ নির্মাতা আমাকে তার চলচ্চিত্রে কাস্ট করেছিলেন। শুধু লিখিত চুক্তি বাকি ছিল। কিন্তু আমাকে না জানিয়েই সেখানে অন্য একজন শিল্পীকে নেন। এটি খুবই অন্যায়। এর আগেও একাধিকবার তিনি এ কাজ করেছেন। আমি নাম বলতে চাই না, আমি ন্যাচারাল রিভেঞ্জে বিশ্বাস করি।
জানা গেছে, ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় মৌখিকভাবে চূড়ান্তের পর শেষ মুহূর্তে দীঘিকে বাদ দিয়ে সিনেমাটির পরিচালক রায়হান রাফি চিত্রনায়িকা তমা মির্জাকে চুক্তিবদ্ধ করিছেন। এরপর রায়হান রাফি গণমাধ্যমে দীঘিকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন। সেখানে তিনি দীঘিকে বলেন, ‘তোমার যোগ্যতা নাই তাই তোমাকে কেউ কাজে নেয় না।’ দীঘিকে নিয়ে রাফির এমন মন্তব্যের জেরে আরও বেশি সমালোচনা তৈরি হয় নেট দুনিয়ায়। অনেক সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা রাফির এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়।
জায়েদ খানকে ওমর সানীর চড় ও মৌসুমীর বয়ান
জায়েদ খান, ওমর সানি ও মৌসুমীর সম্পর্ক ছিল একই সুতোয় গাঁথা। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাপিয়ে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন একসঙ্গে তারা। হঠাৎ করেই তাদের সম্পর্ক বেঁকে যায়। জায়েদ খানকে সপাটে চড় মেরে বসেন ওমন সানী। চড় খেয়ে জায়েদও নাকি পিস্তল নিয়ে ওমর সানির দিকে ধেয়ে যান।
এ বছর তাদের নিয়ে এমন বিতর্ক শুরু হয়। জানা গেছে, ১০ জুন রাজধানীর একটি কনভেনশন সেন্টারে ছিল অভিনেতা-প্রযোজক ডিপজলের ছেলের বিয়ের আয়োজনে এমন ঘটনা ঘটে। তবে ওমর সানী এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেও পুরোটা অস্বীকার করেন জায়েদ। বিস্ময় প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমকে জায়েদ বলেছেন, ‘এমন কিছু ঘটেনি। আর আমি বিয়ের দাওয়াতে পিস্তল নিয়ে যাব কেন? ওমর সানী আমাকে চড়ও মারেননি।’
তবে ওমর সানী বলছেন ভিন্ন কথা, ‘কনভেনশন সেন্টারে ঢুকেই আমি ওকে চড় মেরেছি। সে আমাকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দিয়েছে। এ সময় রোজিনা আপা, অঞ্জনা আপা, সুচরিতা আপারা উপস্থিত ছিলেন।’
জানা গেছে, মৌসুমীর সঙ্গে ‘বেয়াদবি’ করার অভিযোগে জায়েদকে শাসিয়েছেন ওমর সানী। তিনি বলেন, ‘বেয়াদবির একটা সীমা আছে। ও (জায়েদ) ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে সবার সঙ্গে বেয়াদবি করবে, সব মেয়েমানুষের সঙ্গে বিকৃত আচরণ করবে এসবের একটা সীমারেখা আছে। সে মৌসুমীর সঙ্গে বেয়াদবি করার চেষ্টা করেছিল। আমি সেটার জবাব দিয়েছি।’
এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি সারাদেশে। সমালোচিত হয় জায়েদ, ওমর সানি ও মৌসুমী। এরপর ২ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের একটি অডিও বার্তা প্রকাশ করে মৌসুমী। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমার প্রসঙ্গ টানার কোনো প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। আমি জায়েদকে অনেক স্নেহ করি। সে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। আমাদের মধ্যে যতটুকু কাজের সম্পর্ক, সেটা অনেক ভালো সম্পর্ক। সেখানে আমাকে অসম্মান করার প্রশ্নই ওঠে না এবং ওর মধ্যে আমি গুণ ছাড়া অপ্রীতিকর কিছুই দেখি না। কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, সেটা আমি দেখিনি। ও ভালো ছেলে। সে আমাকে কখনোই অসম্মান করেনি।’
মৌসুমীর এমন বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমুল বিপাকে পড়েন ওমর সানী। তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন ওমর সানী ও মৌসুমির সংসার হয়তো আর বেশিদিন টিকবে না। এসব ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে এক ছাদের নিচেই থাকছেন এই তারকা জুটি।
এএম/এসএন