শ্রদ্ধাঞ্জলি
পুনীতের কাছে শাকিবদের শেখার আছে অনেক কিছু
সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের কন্নড় ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা পুনীত রাজকুমার মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে গোটা সাউথ ইন্ডিয়ায় এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রায় এক কোটি মানুষ পুনীতের শোকে সেদিন তাদের কাজকর্মে ফেলে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে এত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল যে, পরিস্থিতি সামলাতে কর্ণাটক সরকারকে শেষ পর্যন্ত কারফিউ জারি করতে হয়েছিল। মৃত্যুর পরেও টানা কয়েকদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ তার বাড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় জড়ো হতো তার প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপনের জন্য। পুনীতের পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, এখনও প্রতিদিন সেখানে হাজারো মানুষ জড়ো হয়! তার জন্য এত মাতম কেন, এত ভালোবাসা কেন?
পুনীত রাজকুমার একজন সিনেমার হিরোই তো! তা-ও মাত্র সাড়ে ছয় কোটি মানুষের রাজ্য কর্ণাটকের আঞ্চলিক সিনেমায় অভিনেতা ছিলেন। আমাদের দেশের হিরোদের মত দুই/ তিন’শ সিনেমায় অভিনয় করেননি। নায়ক হিসাবে মাত্র ২৯টা সিনেমায় পর্দায় এসেছিলেন। শিশু শিল্পী হিসাবে আরও গোটা পনের ছবি। তার জন্য এমন মাতম কেন?
খালি চোখে দেখলে গোটা ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সিনেমার এক অভিনেতার বাইরে বের হয়ে মানুষের হৃদয়ে কতটা আসীন হতে পারেন; পুনীত তার মৃত্যুর মাধ্যমে সেটা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। পুনীতের প্রতি মানুষের যে বিপুল ভালোবাসা, এজন্য অভিনয়ের পাশাপাশি তার নানা সামাজিক ও দাতব্য উদ্যোগও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি।
পুনীতের অভিনয় জীবন প্রায় তার বয়সের সমান। মাত্র ছয় মাস বয়সে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন ছোট্ট পুনীত। অভিনয়টা রক্তে বয়ে এনেছিলেন। কন্নড় কিংবদন্তি অভিনেতা ড. রাজকুমারের কনিষ্ঠ পুত্র তিনি। ফলে শিশু পুনীত প্রায় বড় হওয়ার আগেই ডজন খানেক ছবিতে অভিনয় করে ফেলেন। পরেছেন শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পীর জাতীয় ও আঞ্চলিক মুকুট। এরপর কিছুটা বিরতি। পারিবারিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন কয়েক বছর। তারপর ২০০২ সালে নায়ক হিসাবে পর্দায় হাজার হলেন তিনি। তার প্রথম সিনেমার নাম আপ্পু! আপ্পুর নাচ পছন্দ হয়ে গেল জনতার। ভালবেসে তাকে আপ্পু ডাকতে শুরু করলেন তারা।
তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি পুনীত। ২৯টি চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রায় প্রতিটিা ছবি ব্লক ব্লাস্টার হিট। মাত্র ছয়টা ছাড়া বাকি সবগুলো ছবি টানা ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়েছিল। পুনীত মানেই যেন হিট! প্রযোজকের লগ্নি ফেরতের নিশ্চয়তা! জনতা ভালবেসে নতুন নাম দিল, ‘পাওয়ার স্টার!’ সে নামও পুনীত সাদরে গ্রহণ করেছেন। ভারতের অন্যতম সর্বাচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতা হয়ে উঠলেন। গান গাইতেন। তার গাওয়া গান লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। হয়ে উঠলেন কন্নড় টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় হোস্ট! প্রযোজনা তো ছিলই। দক্ষিণ ভারতে দেশের নামকরা বহু ব্র্যান্ডের এ্যাম্বেসেডর পুনীত। যেদিকে তাকাচ্ছেন, হীরে হয়ে ঝলমল করে উঠছে সব। পুনীতের যে খুব তাড়া ছিল! মাত্র যে ৪৬ বছরের আয়ু ছিল তার!
কিন্তু তাই বলে মৃত্যুর পর এত ভালবাসা মানুষের? আসলে একজন অভিনেতা থেকে সত্যিকারের এক মানুষ হয়ে উঠেছিলেন আমৃত্যু হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী পুনীত! মানুষ পুনীত অভিনেতা পুনীতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর জানা গেল, পুনীত ২৬টা অনাথ আশ্রম, ১৬টা বৃদ্ধাশ্রম, ১৫টা ফ্রি স্কুল চালাতেন। প্রায় ১৮০০ দরিদ্র ছাত্রীর পড়ালেখার দায়িত্ব একা সামলাতেন তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘শক্তিধামা’-এর মাধ্যমে। তার ছিল ১৮টা গরুর খামার।
মৃত্যুর আগে পুনীত তার চোখ জোড়াও দান করে গেছেন। পুনীতের বাবা ড. রাজকুমার ছিলেন চক্ষু দানকারীদের মধ্যে অগ্রগামী। রাজকুমারের নামে সেখানে গড়ে উঠেছে ‘আই ব্যাংক’। বাবার পথ ধরে পুনীতও মৃত্যুর আগে তার অনিন্দ্য সুন্দর চোখ জোড়া দান করে গেছেন। পুনীতের মৃত্যুর খবর হাসপাতালকে জানানোর পরপরই তারা এসে পুনীতের চোখ জোড়া সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এক জোড়া কর্ণিয়া দিয়ে এখন ৪ জন মানুষ এই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পুনীতের মৃত্যুর পর গোটা কর্ণাটকে এখন চক্ষৃদান রীতিমত এক মুভমেন্টে রূপ নিয়েছে। পুনীতের মৃত্যুর খবর শুনে আত্মহত্যা করা দুই যুবক তাদের কর্ণিয়া দান করে গেছেন। নারায়না নেত্রালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. ভুজঙ্গ শেঠি বলছিলেন, ‘পুনীতের মৃত্যুর ৪/৫ দিনের মাথায় অন্তত: ১৫০০ মানুষ মৃত্যু পরবর্তী তাদের চক্ষু দানের অঙ্গীকারপত্রে সাক্ষর করে গেছেন।’ মিন্টো আই হসপিটালের পরিচালক ড. সুজাতার মতে, ‘পুনীতের মৃত্যুর পর চক্ষু দানের সংখ্যা বেড়েছে আগের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ। যা চোখের আলোর অপেক্ষায় থাকা হাজারো মানুষের জন্য এক বিরাট খবর।’
প্রশ্ন আসছিল, পুনীত মারা যাওয়ার পর তার এসব দাতব্য প্রতিষ্ঠান চলবে কি করে? সেটা নিয়েও খুব বেশি ভাবতে হয়নি। ওখানকার নায়ক বিশাল ও আরেকজন মিলে সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। স্কুল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মেয়েদের পড়ালেখা ঠিকঠাক চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। মাত্র ৪৬ বছর বেঁচে ছিলেন এই নায়ক। কিন্তু এই মধ্য বয়সেই মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন তিনি।
এখানেই বোধ হয় শিল্পের দায় থাকে। যেটা আমরা গোটা পৃথিবী জুড়েই দেখতে পাই। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের এখানে অনেকখানিই অনুপস্থিত। এক ইলিয়াস কাঞ্চনের গড়ে তোলা নিরাপদ সড়ক চাই দিন দশকের ব্যবধানে এক জাতীয় মুভমেন্টে রূপ নিয়েছে। এছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কেউ কেউ হয়তো নীরবে-নিভৃতে করছেনও। কিন্তু সেটা খবরে আসার মত হয়তো কিছু না, ফলে জানতেও পারিনি আমরা। অথচ শিল্পীদের একটা মহৎ কাজ তার লাখো অনুরাগীদের মনে ছন্দের দোলা দেয়। অুনপ্রাণিত হন তারাও। আমাদের চলচ্চিত্রঅঙ্গনে শাকিব, শুভ, সিয়ামসহ অনেক তারকা অভিনেতা আছেন। শাকিব খান দেড় দশক ধরে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির নাম্বার ওয়ান হিরো। বুঝাই যায় যে, কী পরিমাণ টাকা তিনি আয় করেছেন। এখন তিনি আমেরিকায় নাগরিকত্বের জন্য মার্কিন মুল্লুকে অবস্থান করছেন। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পুনীত রাজকুমারের কাছে শাকিবদের শেখার আছে অনেক কিছু।
কোভিডের শুরুর দিকে আমাদের সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা টনি ডায়েসের উদ্যোগে একটা ভিডিও বানানো হয়েছিল। জনপ্রিয় সেই ভিডিওতে প্রায় ১০/১৫ জন খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী কথা বলেছিলেন। কথা বলার বিষয় ছিল, এ যাত্রায় বেঁচে গেলে কে কী করবেন। যতদূর মনে পড়ে, কেউ নিজেকে ভালবাসার কথা বলেছেন, কেউ প্রাণভরে বাঁচার ইচ্ছা পোষণ করেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব মোটেও খারাপ কথা না। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের জীবনটা যাপন করা খুব জরুরি। সেই অধিকারও আমাদের আছে। কিন্তু সেই ভিডিওটায় দুটো জিনিস ব্যাপার খুব চোখে লেগেছিল। অনেককেই সেটা নিয়ে কথা বলতে শুনেছি।
প্রথমটা হল, তারা কেউ বলেননি যে, বেঁচে গেলে দেশের জন্য কী করবেন, যারা তাদেরকে স্টার বানালেন, বাড়ি-গাড়ি দিলেন, সেসব খেটে খাওয়া, প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কী করবেন, সেটাও কেউ বলেন নি৷ দ্বিতীয় জিনিস যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হল, ওই ভিডিওতে যারা কথা বলেছেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই এখন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় প্রবাসী। অত্যাধুনিক দেশে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন সবাই। মিডিয়ার মত একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তারা দূরে নিরাপদ জীবন বেছে নিয়েছেন। তার ফল কিন্তু আমরা হাতেনাতে টের পাচ্ছি। এখন মিডিয়ার যে অবস্থা, তার জন্য কি তারা দায় এড়াতে পারেন?
তাহলে যারা তাদেরকে স্টার বানালো, পোশাক কারখানায় দৈনিক ৪০০ টাকা বেতনে কাজ করে বেরিয়ে এসে দেড়'শ টাকার টিকেট কেটে যার ছবি দেখলো, সেই অভিনেতার কী সেসব মানুষের প্রতি কোনও দায় থাকে না? অথবা, আমরা যারা সেই ছোটবেলা থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে এসে চাকরি বাকরি করি তাদের কি দেশের প্রতি কোনও দায় নেই? অথচ দেশটা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পেছনে প্রতি মাসে ১৯ হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়। মেডিকেলে পড়া একজন ছাত্রের পিছনে এ হার মাসে প্রায় ৫১ হাজার টাকা। সেই ভর্তুকির টাকা যোগান দিয়েছে এদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক জনতা। তাহলে সেই কৃষক সামান্য সেবার জন্য সরকারি অফিসে গেলে তার কাছ থেকে কী করে সেই বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা সাহেসবটা ঘুষ নেয়?
কোভিডে দেখেছি, যাত্রা শিল্পী, মঞ্চ নাটক কিংবা সিনেমার এক্সট্রা শিল্পীরা কী মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। তাদের পাশে শিল্পীদের খুব সাড়ম্বরে দাঁড়াতে দেখিনি। ব্যক্তিগত উদ্যাগে কেউ কেউ কিছু করেছেন হয়তো। বরং, সরকারের পাঠানো সামান্য কিছু সাহায্য নেয়ার জন্য তাদেরকে শিল্প কলায় লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেই ছবি ফেসবুকে দেখেছি।
এটা শুধু এই ক্ষেত্রে না, প্রায় সবক্ষেত্রেই সত্য। আমাদের দেশে দেশপ্রেমটা কেন যেন বিলাসিতার নামান্তর হয়ে গেছে। একটু টাকা পয়সা হলে তো ওটাকে আদিখ্যেতা বলে রীতিমতো গাল দেয়া হয়। বলছি না পুনীতের মতো হাজারো মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে বসতে হবে সবাইকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কাজ করলে ব্যক্তির দায় হারিয়ে যায় না, যেখানে প্রতিষ্ঠান অসমর্থ সেখানে ব্যক্তির দায় দায়িত্বে পর্যবসিত হয়। তা হলে শুধু সিনেমার পর্দায়, ক্রিকেট মাঠ কিংবা পোশাক রপ্তানিতে হিরো হয়ে লাভ কি যদি মানুষের হৃদয়ে না পৌঁছুতে পারলাম?
এখানেই পুনীতি শিল্পের দায়টা ঠিকঠাক মিটিয়েছেন। সিনেমা শিল্পকে যেমন অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন, তেমনি মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি দায়িত্বের খাতাটাকে ভরিয়ে তুলেছেন সুখপাঠ্য সব চ্যাপ্টারে।
ভালবাসা জানবেন, আপ্পু।