কে এই কর্ণেল টম পার্কার?
অষ্ট্রেলিয়ান পরিচালক বাজ লুওম্যান পরিচালিত ও স্যাম ব্রোমেলের সঙ্গে তার লেখা যৌথ চিত্রনাট্যে পপ সুপারস্টারের ‘এলভিস’ ছবিটি এখন সিনেমা হলে। সঙ্গীতনির্ভর ছবিটি এলভিসের অল্পদিনের জীবন অবলম্বনে বানানো। অস্টিন বাটলার মার্কিন পপ আইকনের চরিত্রে অভিনয় করছেন। মোটে ৩০ বছরের অভিনেতা। এটিই তার প্রথম সিনেমা। একজন আমেরিকান অভিনেতা তিনি। এর আগে অভিনয় করেছেন ডিজনি চ্যানেল ও শিশুদের জন্য টাকার বিনিময়ে দেখা ‘চ্যানেল নিকেলোডিয়ান’-এ। শিশু তারকা হিসেবে দারুণ দক্ষ।
তবে উল্লেখযোগ্য হলো, হলিউডের মহাতারকা টম হ্যাংকস তার সঙ্গে আছেন সিনেমাটিতে। তিনি ‘কর্নেল টম পাকার’। ছবির গল্পই শুরু হয়েছে ১৯৭৯ সালে। এলভিসের সাবেক ম্যানেজার তার মৃত্যুশয্যায় ফিরে তাকালেন, কীভাবে তার ভবিষ্যতের পপ কিংয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। ২৫ মে এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে ছবিটির যাত্রা শুরু হয়েছে। এরপর অষ্ট্রেলিয়াতে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ২৩ জুন। পরের দিন এলভিসের দেশ আমেরিকাতে মুক্তি পেয়েছে। ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটে এর মধ্যেই আয় করেছে ৫৫ মিলিয়ন ডলার।
মিসিসিপিতে জন্ম নেওয়া এলভিসের পুরো নামটি হারিয়ে গিয়েছে তার খ্যাতির ভুবনে। পুরো নাম এলভিস অ্যারেন প্রিসলি। মোটে ৪২ বছরের জীবন তার। একজন অত্যন্ত বিখ্যাত মার্কিন গায়ক ও অভিনেতা। তাকে ‘কিং অব রক অ্যান রোল’ বলা হয়। ২০ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত, তারকাদের অন্যতম। সঙ্গীতের অন্যতম সেরা। কারো, কারো মতে সবার সেরা। রক অ্যান রোলে তো বটেই। তিনি তার স্টাইল, যৌনাবেদনময় জীবন ইত্যাদি কারণেও খ্যাতিমান।
তার জীবনের নেপথ্য নায়ক, কর্ণেল টমাস অ্যান্ড্রু পার্কার একজন ডাচ-আমেরিকান সঙ্গীত উদ্যোক্তা। এলভিসের ম্যানেজার হিসেবেই খ্যাতিমান তিনি। মারা গিয়েছেন ১৯৯৭ সালের ২১ জানুয়ারি। মোট ৮৭ বছরের দীর্ঘ জীবনের অধিকারী। তাকে ‘দি টাম্পা ডগক্যাচার’ নামেই লোকে চেনে। তিনি ‘রাজা’কে ম্যানেজ করতেন বলে এখনো সুবিদিত হয়ে আছেন। বিতর্ক আছে, রক অ্যান রোলের রাজার আয়ের ৫০ ভাগ তিনি ভাগ বসাতেন। তিনি জীবদ্দশায় এই কৌতুক করতে অভ্যস্ত ছিলেন, তিনিই সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ডগক্যাচার’। শব্দটির অথ এমন, বেয়াড়া প্রতিভাদের যারা কাজে লাগান। লোকে তাকে কর্ণেল নামে ডাকত। তার চরিত্রটিই করেছেন টম হ্যাংকস।
চরিত্রটি নিয়ে হলিউডের সুপারস্টার ও অন্যতম সেরা অভিনেতা তার সামনে ছবিটির প্রদর্শনীর সময় বলেছেন, ‘কর্ণেল টম পার্কার ছিলেন একজন কৌশলী, খাঁটি ও সাধাসিধে মানুষ। এখন এই ধরণের মানুষকে অলস বলে মনে করা হয়। তিনি এমন একজন, যারা এই ধরণের জাদুকরী আলোগুলোকে বুঝতে পারতেন, যারা শহরের প্রান্ত থেকে তাদের ধরে এনে পুরো শহরের মানুষের তাদের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করাতেন। যারা ভালো সময় কাটাতে চাইতেন, গান ভালোবাসতেন।’
পার্কারের জীবনের দীর্ঘসময় রহস্যময়তায় কেটেছে। তিনি দাবী করেছিলেন যে, তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে পরে প্রমাণিত হয়েছে, একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি চলে এসেছেন জন্মস্থান নেদারল্যান্ডস থেকে। তার আসল নাম হলো, আন্দ্রেয়াস কর্ণেলিস ফান কোক।
মার্কিন সেনাবাহিনীতে টম পার্কার নামে সেবা করেছেন। তিনি ছুটি না নিয়ে অনুপস্থিত ছিলেন এবং এজন্য তাকে স্বল্পকালের জন্য একাকী আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফলে কোনোদিনও তিনি কর্ণেল পদবীটি লাভ করেননি। তাকে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর নামটি ভালোবেসে দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি হয়েছেন ‘কর্ণেল টম পাকার’।
তিনি তার সঙ্গীতের ব্যবসা জীবন শুরু করেছেন সেই আমলে। দারুণভাবে। তার মেলা বা প্রদর্শনী করার জন্য কার্নিভালের সামর্থ্য ছিল। এই জীবনের শুরু ১৯৩০’র দশকের শুরুতে। তাকে পরিচিত করালো টাম্পা। এটি মেক্সিকোর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি উপসাগরীয় শহর। ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি প্রধান শহর। এখানে স্লাইডশোগুলো করার কর্মচারীরা কর্মহীন সেশনগুলোতে বাস করতেন।
কর্ণেল টম পার্কারের হৈ, চৈ ফেলে দেওয়া শোর মধ্যে ছিল ‘কর্ণেল টম পার্কার ও তার নাচুনে মুরগির বাচ্চাগুলো’। টাম্পা শহরের এই শোতে তিনি তার জীবন্ত মুরগির বাচ্চাগুলোকে কাঠের মিহি গুড়ার একটি বেশ গরম প্লেটে রাখতেন। সঙ্গীতের তালে, তালে সেগুলো ওখানে নাচতো-লেখা আছে টাম্পা ট্রিবিউনের প্রবন্ধে। তিনি স্বল্পকালের জন্য কান্ট্রি মিউজিক বা মার্কিন দেশের গানের তারকা জিন অস্টিনের প্রচারাভিযানকারী বা ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। এই পুরুষ তারকা গীতিকারও ছিলেন। তার ‘মাই ব্লু হ্যাভেন অ্যালবাম’টি ৫০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। ১৯০০ সালে জন্মেছেন ও ১৯৭২ সালে মারা গিয়েছেন। অ্যালবামটি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অ্যালবামগুলোর একটি। তিনি পুরোপুরিভাবে টাম্পাতে স্থায়ী ছিলেন।
এখানে কর্ণেল টম পাকারের শোম্যান শিপের একটি ধরণও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছুটির দিনগুলোতে সান্তা ক্লজের পোশাকে বেরিয়ে পড়তেন ও শিশুদের কুকুর উপহার দিতেন। তবে এগুলোর সত্যতা জানা যায়নি। তার কাজের মধ্যে আছে একটি গৃহপালিত পশুদের কবরখানা তৈরি। তার স্ত্রীর নাম মেরি। ১৯৪৩ সালে কর্ণেল টম পার্কার আবার তার শো ব্যবসায় ফিরে এলেন। তখন তিনি নাশভিলভিত্তিক ‘গ্রান্ড ওল অপরি’র একজন এজেন্ট। এটি একটি মার্কিন সাপ্তাহিক দেশের গানের কনসার্টের স্টেজ। টেনেসির নাশভিলে আছে। ১৯২৫ সালে শুরু।
এখানেই আবার মার্কিন দেশের গানের তারকা এডি আরনল্ড (টানা ছয় দশক গান করেছেন। নাশভিলের এই তারকার ১শ ৪৭টি গান বিলবোর্ডের তালিকায় ছিল। তিনি প্রধান দুইজন তারকা তালিকা গায়কের একজন।) ও হাঙ্ক শো (১৯৫০ দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মার্কিন কান্ট্রি গায়ক। তিনি ৫০ বছরের বেশি গান করেছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ১৪০টি অ্যালবাম করেছেন ও ৮৫টির বেশি গান তার তালিকাতে এসেছে)’কে তুলে আনতে পেরেছেন।
এরপর তিনি নিজের বুকিং এজেন্সি গড়ে তুলেছেন। এখানেই ১৯৫৫ সালে গান করার জন্য এলভিস এলেন। তাদের জীবনের শুরু হলো। যখন একেবারেই অচেনা, তাকে টম পার্কার একটি গানের জন্য বুক করলেন। কী দেখলেন তিনিই জানেন, এরপর ২শ শোর জন্য এলভিস প্রিসলিকে চুক্তিবদ্ধ করালেন তিনি নিজের কম্পানিতে। তাকে নিজের সবই দিলেন। তৈরি এবং বিকশিত করলেন বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শো বিজনেস আকর্ষণ হিসেবে।
ম্যানেজাররা সাধারণত ১০ ভাগ তার খদ্দেরের রয়ালিটি নিয়ে থাকেন। তিনি ৫০ ভাগের জন্য এলভিসের সঙ্গে সফল আলোচনা করেছেন। কারণ হলো, এর চেয়ে ভালো কাউকে এলভিস চিনতেন না ও তাকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করতেন। এলভিস প্রিসলি বলেছেন ১৯৫৭ সালে, ‘জানতাম, তার সঙ্গে আমি একটি সমান্তরাল চুক্তিতে যাচ্ছি। হলিউডের কজন বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন। কর্ণেল টম পার্কার সেই ধরণের মানুষ যার সঙ্গে আমি বড় হয়েছি।’
একটি শস্যাগার বা ভবিষ্যতে কাজে দেবে সবসময়-এমন একটি ট্যুর এলভিসের নাম তৈরির জন্য আয়োজন করলেন এরপর কর্ণেল টম পার্কার। এরপর তাকে টিভি শোগুলোর জন্য বুক করলেন। তারপর তাকে নিয়ে গেলেন সিনেমাতে। এই ছবির মাধ্যমেই এলভিস প্রিসলি একজন আন্তর্জাতিক তারকা হয়েছেন।
কর্ণেল টম পাকার এলভিস প্রিসলিকে নিয়ে একবার বলেছেন ‘যখন এলভিসকে আমি পেলাম, তখন এই শিশুটির ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের মেধা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এখন তার এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার আছে।’
এলভিসের প্রথম দিকের একটি কনসার্ট করেছেন তিনি ১৯৫৬ সালে। হয়েছে টাম্পার ফোর্ট হোমার হ্যান্টলি আর্মারিতে। এটি সেনাদের একটি ঐতিহাসিক ভবন। টাস্পাতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কর্ণেল টম পার্কার আরেকটি শোটি করলেন, যখন মার্কিন নামকরা বিনোদন সাংবাদিক তার ‘এড সালেভান শো’টি করবেন। এড সালেভানের শোতে নামকরা সঙ্গীতবিদরা কাজ করতেন। ক্যামেরাগুলোর কোনো বিরাম থাকতো না। তিনি তাকে তখন ভক্তদের হাত থেকে লুকিয়ে রাখলেন এবং নিয়ে গেলেন হিউমেইন সোসাইটি ভবনে।
মার্কিন জাতীয় গণমাধ্যমগুলো পার্কার ও এলভিসের জন্য মোহিত ছিল। তাদের সম্পর্ক নিয়ে এপি লিখেছে, ‘১৯৫৬ সালে তারা বছরটিকে হাউন্ড ডগের বছরে পরিণত করেছেন।’ এটি প্রিসলির একটি গান ও পার্কারের আগের চাকরি থেকে নেওয়া বাক্য।
১৯৭৭ সালে এলভিস প্রিসলি মারা গেলেন। আনুষ্ঠানিক কারণ হলো, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। তবে নানা পরীক্ষায় তার শরীরে উচ্চমাত্রার মাদকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। এরপরও পার্কার তার আয় থেকে ৫০ ভাগ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করেছেন।
১৯৮০ সালে তাদের জীবনের ওপর বেশি লেখা দি টাম্পা ট্রিবিউন লিখলো, ‘তাদের চুক্তির মাধ্যমে কর্ণেল টম পার্কার আনুমানিক ১শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছেন।’
‘দি প্রেসলি এস্টেট’ পার্কারকে তার রয়্যালিটির ভাগ থেকে সরে আসার জন্য মামলা দায়ের করলো। ১৯৮৩ সালে তারা আদালতের বাইরে এই চুক্তিতে এলেন যে, পার্কারকে তারা ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবেন। তবে এজন্য তাকে এলভিসের সুনামের অংশীদার হিসেবে রাখতে ও সেসব লাভ গ্রহণ করতে রাখতে হলো।
এভাবেই ‘দি টাম্পা ডগক্যাচার’ প্রিসলির জীবনে থেকে গেলেন। এই বিষয়ে লেখা আছে-‘এলভিস প্রিসলি কারো সঙ্গেই তুলনীয় নয়, কেউই তার সমকক্ষ নন। তিনি এমন একজন রেকডিং আর্টিস্ট বা পর্দার, অ্যালবামের গানের শিল্পী হিসেবে সাফল্য লাভ করেছেন। সেখানে নির্দিষ্টভাবে কর্ণেল টম পার্কারের অবদান আছে। এখান থেকে প্রিসলি, তার এস্টেট, পার্কার, সবকিছুই লাভবান হয়েছে এবং উপকার পেয়েছে।’
ছবি : টাম্পা শহরের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে ম্যনেজার ও গুরু কর্ণেল টম পার্কারের সঙ্গে রক অ্যান রোল আইকন এলভিস প্রিসলি। ২. তারা দুজনে ১৯৬৯ সালে। ৩. টম পার্কারের চরিত্রে অভিনয় করা টম হ্যাংকসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক প্রেসিডেনশিয়ান মেডেল অব ফ্রিডম পরিয়ে দিচ্ছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০১৬ সালে।
ওএস।