‘যাপিত জীবন’ ও একজন নির্মাতার নকশা
নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব
সিনেমা মূলতঃ দৃশ্যনির্ভর। এই দৃশ্যকে ফুটিতে তুলতে প্রয়োজন শব্দের। যেটি মূল দৃশ্যগুলো এক সূত্রে বেঁধে রাখে একটি গল্প দিয়ে। দৃশ্যায়ন করার সুবিধার জন্য গল্পটি লেখেন এক বা একাধিক স্টোরি রাইটার। নিটোল একটি গল্প দৃশ্যের পর দৃশ্যে ছন্দে গাঁথেন পরিচালক। কখনো পরিচালক বেছে নেন কালজয়ী জনপ্রিয় একটি উপন্যাস বা গল্পকে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে সাহিত্যিক উপন্যাস বা গল্প লেখেন। সাহিত্যিকের গল্পের ছবিটি দৃশ্যায়ন উপোযোগী করে গড়ে তুলেন চিত্রনাট্যকার। বহু মানুষের কর্মযজ্ঞকে একসূত্রে পরিচালিত করেন সিনেমাটির পরিচালক। এজন্য সিনেমাকে বলা হয় ডিরেক্টরস মিডিয়া।
বাংলা সিনেমার শুরু থেকে সাহিত্য সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হতে তারাশংকর, বনফুল, মানিক বন্দোপাধ্যয়, সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল মিত্র বহু সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাসকে অবলম্বন করে বহু বিখ্যাত সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এই সিনেমাগুলো জনপ্রিয় হয়েছে এর অনেকগুলোই আখ্যা পেয়েছে কালজয়ী’র। টালিউড তথা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমাকে তাই বলা যায় সাহিত্য নির্ভর। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ ছিল নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বন করে বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে পঁচাত্তরটি সিনেমা।
১৯৫৬ সালে নির্মাণ শুরু হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা সিনেমার। মুখ ও মুখোশ নামের সিনেমাটির পরিচালক আব্দুল জব্বার খান গল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিজের লেখা একটি নাটক ‘ডাকাত’ অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তীতে বাংলাদেশের বাংলা সিনেমার সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগ খুব একটা ছিল না। জহির রায়হান পাকিস্তান সময়কালে নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ অবলম্বনে একই নামে সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। বাংলাদেশ সময়ে বেশকটি সাহিত্য নির্ভর সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন নির্মাতারা। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ক্লাসিক উপন্যাস লাল সালু অবলম্বনে মসিহউদ্দিন শাকেরও নিয়ামত আলি নির্মাণ করেছিলেন একই নামের সিনেমা। আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বন করে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেছিলেন ‘বসুন্ধরা’ নামে সিনেমা। হুমায়ুন আহমেদের ‘শংখনীল কারাগার’ অবলম্বন করে মুস্তাফিজুর রহমান তৈরি করেছিলেন একই নামে সিনেমা। জনপ্রিয় উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদ নিজের লেখা উপন্যাস নিয়ে নিজেই নির্মাণ করেছিলেন একাধিক সিনেমা। এরমধ্যে উল্লেখ করা যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা ‘শ্যামল ছায়া’।
সরকার বাংলা সিনেমার মান উন্নয়নে অনুদান ঘোষণা করলে সাহিত্য নির্ভর সিনেমা তৈরির দুয়ার খুলে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রখ্যাত উপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘যাপিত জীবন’ অবলম্বনে সিনেমা তৈরির অনুদান অনুমোদন পান চলচ্চিত্র নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাংগর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে প্রয়াত আখতারুজ্জামান নির্মাণ করেছিলেন একটি সিনেমা। সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসটির গল্পের সময়কাল দেশভাগ থেকে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। বিশাল ক্যানভাসে সেলিনা হোসেন যাপিত জীবনের সে সময়ের ছবি এঁকেছেন শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে। এই সময়কেই তুলে আনতে হবে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে চলচ্চিত্রের ভাষায়। কাজটি খুব সহজ নয়। দেশ ভাগ শুধু দেশেরই ভাগ হয়নি। দেশ ভাগ হয়েছে ধর্মকে ভিত্তি করে। মুসলিম জাতীয়তাবাদকে শিখন্ডি করে পাকিস্তান নামের অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় ভারত ভাগ করে। এই নতুন রাষ্ট্রটির দুটি অংশ। একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান অপরটি পূর্ব পাকিস্তান। বিস্ময়কর হলো দুটি ভাগের ভৌগলিক দূরত্ব বারশত মাইল। এই দেশভাগ যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে হয় তাতে বাস্তুচ্যুত হয় লক্ষ লক্ষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। পশ্চিমা ভূস্বামী সামরিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মকে শিখণ্ডি করে যে দেশভাগ করে তার প্রতি পূর্ব অংশের সমর্থন ছিল। এই মানসিকতার উপাদান হিসেবে কাজ করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। এই শ্রেণিটি কলকাতায় থেকে শোষণ চালিয়েছে পূর্ব অংশে। দেশভাগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত হিন্দু ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়। যাপিত জীবনে সেই সময়ের অনুভূতি তুলে আনাটাও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম চিন্তা চেতনা। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল তাদের ধর্মকে নিয়ে যে মোহ কল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা ভেঙে যেতে দেরি হয়নি। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করায় মোহ ভাঙায় অনুঘটকের কাজ করেছে। ৪৭ সালেই শাসক পক্ষের বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত করায় মোহ ভাঙার প্রকাশ্য সূচনা করে। যার পরিণতিতে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন। বলা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা যার সমাপ্তি ঘটে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যাপিত জীবন উপন্যাসটি শুধু গল্প নয় ইতিহাস ও তৎকালীন মননের ছবি।
এটি তুলে ধরতে হবে চলচ্চিত্রের ভাষায়। নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব ‘যাপিত জীবন’ নির্মাণ পরিকল্পনা করতে গিয়ে সেই চ্যালেঞ্জটি নিয়েছেন। এর আগে হাবিবুল ইসলাম হাবিব ‘রাত্রির যাত্রী’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তবে শিল্পকলার ক্ষেত্রে তিনি নবাগত নন। দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চ নাটক নির্দেশনা, শর্ট ফিল্ম ও টেলি নাটক নির্মাণের অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে রয়েছে। তিনি ‘যাপিত জীবন’ চিত্রায়িত করার পূর্বে গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে চান। বিশাল ক্যানভাসকে সেলুলয়েড বন্দি করতে, সেই সময় সেই মননকে তুলে ধরে একটি ভালো সিনেমা নির্মাণ করতে খুটিনাটি বিষয়কেও নজরে রাখছেন সেটি আমাদের একটি ক্লাসিক সিনেমা দেখেবে বলে আশাবাদী করে তুলছে। ২০২৩ সালের ভাষা দিবসে সিনেমাটি দর্শকদের সামনে আনতে পারবেন বলে নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব আশাবাদী।
নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব সিনেমা অন্ত প্রাণ।একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেই অন্ধকার সময়ে বছর পাঁচ আগে দাবি তুললেন তিনশ সংসদীয় আসনে তিনশ সিনেপ্লেক্স চাই। সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সিনেমা হল একটি প্রধান অনুসঙ্গ। এই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে তিনি শুরু করলেন একাই সেই আন্দোলন। আজ সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবার এমনকি দর্শকদেরও প্রাণের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দাবিটির গুরত্ব বিবেচনা করে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন সব জেলায় একটি করে সিনেপ্লেক্স ও সব উপজেলায় কালচারাল কমপ্লেক্স তৈরির। এরই মধ্যে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখছি আমাদের কাঁকড়া মানসিকতার। যিনি একা এই আন্দোলনটির সূচনা করে জনমত সৃষ্টি করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দাবিটি বাস্তবায়নের পথে নিয়ে এসেছেন তার সাফল্য ছিনিয়ে নিতে একটি শ্রেণি মাঠে নেমে পড়েছে। যার শ্রমে ঘামে একাগ্রতায় এই সাফল্য তাকে যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করব। মনে রাখতে হবে ইতিহাস বড় নির্মম ইতিহাস চাপিয়ে রাখলেও ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবেই।
হাবিবুল ইসলাম হাবিবের নবতর প্রচেষ্টা ‘যাপিত জীবন’ এর সফলতার জন্য বাঙালিরা অপেক্ষা করে আছে। এটি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের চলমান ছবি, সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে তার নিরলস শ্রমের কৃতিত্বের স্বীকৃতির দাবি রাখে।
আরএ/