শিক্ষার্থী নির্যাতনের খোঁজ নিতে গিয়ে অধ্যক্ষকে ছাত্রলীগের হুমকি
দেশসেরা রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাসে টর্চার সেল গড়ে তুলে এবার সাংবাদিকসহ ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এ ঘটনার পরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রাবাসে গেলে ছাত্রলীগের তোপের মুখে পড়েন কলেজ অধ্যক্ষ। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষসহ সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে হুমকি দেয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। পরে দিবাগত রাত ১টার দিকে পরিবেশ শান্ত হয়। এ ঘটনায় ছাত্রাবাসজুড়ে আতঙ্কে রয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে মারধরের শিকার নাজমুস সাকিব বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময় তাদের দলীয় প্রোগ্রামে জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যায়। আজও বিকালে ছাত্রলীগের একটা প্রোগ্রামে যেতে হয়। সেখান থেকে ছাত্রলীগ নেতা রাফিকে (প্রোগ্রাম কনভেনর) মেডিকেলে যাওয়ার কথা বললে তাকে হোস্টেল ছেড়ে দিতে বলে। তাকে মানিয়ে আমি মেডিকেল যাই। সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টায় হোস্টেলে ফিরলে ছাত্রলীগের শাহরুখ, রাজু, রাফি, হাসানসহ ৮ থেকে ১০ জন মিলে আমার রুমে ঢুকে মারধর করতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, আমার মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু দামি জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। এক পর্যায়ে সব শিক্ষার্থীকে ব্লকে আটকে রেখে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে থাকে, অনেককে মারধরও করে। পরে সকলকে ধাক্কা দিতে দিতে গণরুমে নিয়ে যায়। সেখানে শাসানো হয়। বলা হয়, যদি কারোও কাছে কিছু বলি তাহলে আরও ভয়ানক কিছু করবে। এক কথায় হোস্টেলে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই।
আরেক ভুক্তভোগী শরিফুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় বের হয়ে ব্যক্তিগত কাজে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে নিউজ লিখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ রাশিক দত্তের কর্মী শাহরুখ রুমে ঢুকে পড়ে। কিছু না জিজ্ঞেস করেই অতর্কিত মারতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিক পরিচয় দিলে আরও মারতে শুরু করে। তার সঙ্গে থাকা ছেলেরা এসে আমাকে মেরে রুম থেকে বের করে দেয়। বকাবকি ও ধাক্কাধাক্কি করে অন্য ব্লকে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীদের দেখি, যাদের আটকে রেখেছে। পরে সবাইকে জোর করে নিয়ে যায় প্রোগ্রামে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ঘটনার পরে আমাদেরকে শাসিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি রাশিক দত্ত। তিনি বলেন, ‘যাই করো ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত থাকা লাগবে তা না হলে হোস্টেল থেকে বের করে দিব।’
এদিকে সাংবাদিকসহ শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়টি জানতে পেরে ছাত্রাবাসে গেলে ছাত্রলীগের তোপের মুখে , কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল খালেকসহ ছাত্রাবাস সুপার সহযোগী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মানিক। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষকে হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে কলেজ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের ডাকলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা রুমে ফিরে যায়।
এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল খালেক বলেন, এখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। কোনো রাজনৈতিক দলের নির্যাতন সহ্য করতে না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অন্য রকম সুনাম আছে। আমরা যে ছাত্রলীগ করেছি, এই ছাত্রলীগ কি সেই ছাত্রলীগ!
তিনি আরও বলেন, কলেজে ছাত্রলীগের যে সদস্যরা শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি উর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। রাজশাহী কলেজের যে সুনাম আছে যা কতিপয় নেতার কারণে নষ্ট হতে পারে না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রাশিক দত্ত বলেন, ঘটনাটি আমি শুনেছি। আমার ছেলেরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের ৪-৫ জন করে যদি ২০ জন ছেলে চলে যায় তাহলে আমরা কীভাবে প্রোগ্রাম চালাব? আমাদেরকেও তো রাজনীতি করতে হয়। তবে এরপর থেকে এমন হবে না। তাদের সঙ্গে বসে সমঝোতা করে নেব।
এ প্রসঙ্গে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, 'ঘটনাটি আমি শুনেছি। ঘটনা শুনে আমিও বিব্রত। এর আগে আমরাও ছিলাম, এ রকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। আমরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ছিলাম। এখন তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়।
জানা গেছে, বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের ই ব্লকে এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের শিকার শিক্ষানবীশ গণমাধ্যমকর্মীরা হলেন- কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ও শরীফুল ইসলাম। তারা ক্যাম্পাস সাংবাদিক সংগঠন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরসিআরইউ) সদস্য।
আরও জানা গেছে, কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মিছিল-মিটিং দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। যেতে না চাইলে মারধরসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। নির্যাতন করা হয় টর্চার সেলে। এছাড়া ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী মাদকের রমরমা ব্যবসাও করে ছাত্রাবাসে। বসে মাদকের আসর। আর মাদকের অর্থ জোগাড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন চালিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও আছে।
এসআইএইচ