ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ চাল আমদানিতে দ্বিতীয় কেন
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রতিনিয়তই বলছেন, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তাহলে প্রতি বছর কেন এত চাল আমদানি করতে হচ্ছে? গত অর্থ বছরে তো বাংলাদেশ চাল আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।
ধান-চাল নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, দুর্যোগে ক্ষতি আর মজুদ শক্ত করতেই চাল আমদানি করতে হয়। এ বছরও ৩ লাখ টন ধান দুর্যোগে নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি মানুষের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটা এখানে উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু গবাদি পশু আর পোল্ট্রির জন্য বছরে লাগে ৩৬ লাখ টন চাল। সেটা সামাল দিতেই আমদানি করতে হচ্ছে। এবার গমের সংকটের কারণে ধানের উৎপাদন বাড়লেও চাল আমদানিও বাড়তে পারে। কারণ নিম্নবিত্ত মানুষ অনেকেই রুটির পরিবর্তে এখন ভাত খাচ্ছেন।
ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বললেও এত চাল কেন আমদানি করতে হচ্ছে? জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না।’ দূর্যোগ আর গমের সংকটের কারণে এবার কি চালের আমদানি বাড়তে পারে? এ প্রশ্নের কোন জবাব দেননি মন্ত্রী, আর কোন মন্তব্যও করতে চাননি।
প্রতি বছরই বাংলাদেশ চাল আমদানি করে। এর মধ্যে আবার রপ্তানিও হচ্ছে৷ গত এক যুগে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। গত দুই বছরে যা ছুঁয়েছে ১০ হাজার টনের মাইলফলক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের তথ্য বলছে, দেশ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ হাজার ৫১৭ টন সুগন্ধি চাল বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৭৯ টন। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ হাজার ৮০৫ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ২১০ টন চাল রপ্তানি হয়। অথচ ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাত্র ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। যেটা বেড়ে প্রায় ১১ হাজার টন ছুঁয়েছে।
এ বছর দুর্যোগের কারণে কি পরিমাণ ধান নষ্ট হয়েছে তা জানা গেছে কিনা জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, ‘প্রতি বছরই দুর্যোগের কারণে কিছু না কিছু ধান নষ্ট হয়, সেই প্রস্তুতিও আমাদের থাকে। তবে গত বছর ৪০ লাখ ৯২ হাজার বর্গ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছিল। এ বছর ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার বর্গ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এবার দুর্যোগের কারণে ১৮ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। এতে ৩ লাখ টনের মতো ফলন কম হবে। গত বছর আমাদের উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১৬ টন। আর এবার উৎপাদন হবে ২ কোটি ৮ লাখ টন। এ বছর আমাদের উৎপাদন বাড়বে। তবে বছর শেষ হলে হিসাবটা বোঝা যাবে।’
আমাদের চাহিদার তুলনায় এই উৎপাদন কম না বেশি? জানতে চাইলে জনাব আলম বলেন, ‘আমাদের নিজেদের খাওয়ার জন্য যে চাল প্রয়োজন সেটা এই উৎপাদন দিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু সরকারকে তো আপদকালীন সময়ের জন্য বড় ধরনের মজুদ রাখতে হয়। সেটাই আমদানি করা হয়। এর বাইরে ৩৬ লাখ টন চাল লাগে পোল্ট্রি আর গবাদি পশুর খাবারের জন্য। এই দুই সেক্টরই আমাদের এখানে বেড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে তো কিছু চাল আমদানি করতেই হয়। এবারও আমাদের সেই প্রস্তুতি আছে, কোন সমস্যা হবে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরেই খাদ্যে (চাল ও গম) আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এক দশক আগেও দেশে আমদানি নির্ভরতার হার ছিল এক অংকের (সিঙ্গেল ডিজিট)। কিন্তু ছয় বছর ধরে তা দুই অংকের ঘরে রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তা বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে কথা বলা হচ্ছে তা আসলে সঠিক নয় বলেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমরা আসলে খাদ্যে কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি? জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘আমরা আসলে কখনই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারিনি। গমের অধিকাংশই তো আমদানি করা হয়। আর চাল আমাদের যেটা লাগে সেটা হয়ত উৎপাদন হয়। কিন্তু সরকার যে ১০ লাখ টন মজুদ রাখে সেটা তো আমদানির উপরই নির্ভরশীল। এখানে মূল বিষয়টা হচ্ছে, নিজেদের উৎপাদনের পর যেটুকু আমদানি করা লাগে সেই সক্ষমতাটা অর্জন করা। ধান অধিকাংশই এখানে হচ্ছে। অল্প কিছু আমদানি করতে হয় সেটার সক্ষমতা আমাদের আছে। এখানে বাস্তবতা হচ্ছে দুর্যোগে প্রতি বছরই কিন্তু কিছু না কিছু ধান নষ্ট হচ্ছে। এ বছর কতটা আমদানি করতে হতে পারে সেটা এখনই বলা যাবে না। কারণ সামনের আমন মৌসুমে যদি আমরা বাম্পার ফলন ফলাতে পারি তাহলে খুব বেশি আমদানি করা নাও লাগতে পারে। তবে আমদানি করতেই হবে। সেটা থেকে বের হওয়ার এখনই কোন পথ আমাদের নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে দেশে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি নির্ভরতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে এ নির্ভরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই বছর দেশে খাদ্যশস্যের আমদানি নির্ভরতার হার দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই সময় দেশে প্রায় ১ কোটি টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছিল। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি নির্ভরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) এ হার ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২০-২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিআইডিএস'র সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘খাদ্যশস্যের কৌশলগত মজুদের জন্য আমদানি করা যেতে পারে৷ কয়েক বছর ধরেই তো এটা বাড়ছে। এবার সেটা বাড়তেও পারে। কারণ বিশ্বজুড়ে গমের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে গমের দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ সকালে রুটির বদলে ভাত খেলে চালের উপর চাপ পড়বে। আমদানি কোনোভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিৎ নয়। বেশি আমদানি হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সব ধরনের ঝুঁকি এড়াতে দেশেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমদানি নির্ভরতা কমাতে ফলন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণাসহ কর্মীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি করা দরকার।’
সম্প্রতি সিলেটে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল। এতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. কাজী মজিবুর রহমান বলেন, ‘এপ্রিল এবং মে মাসে সিলেটে দুই দফা বন্যা হয়েছে। এখানে ২ হাজার ২৬৯ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এই জমি থেকে ৬ হাজার ৬৬৫ টন ধান পাওয়া যেত৷ সেটা আর এখন পাওয়া যাবে না। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশের বীজতলা। পুরো এলাকার বীজতলা এখন পানির নিচে৷ সেটা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।’
ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে৷ শীতের প্রকোপ কমে যাওয়ায় নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে গমের উৎপাদন। এছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা দুর্যোগের কারণেও এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
সূত্র: ডয়চে ভেলে