সুইস ব্যাংক কী ও কীভাবে কাজ করে?
সুইস ব্যাংক ব্যবস্থায় গোপনীয়তার ইতিহাস ৩০০ বছরের পুরোনো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কর ফাঁকি দিতে ইউরোপের দেশগুলো থেকে ধনীরা সুইস ব্যাংকে ভিড় বাড়ায়। অ্যাডলফ হিটলারও সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন। সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখলে সুদ পাওয়া যায় না, বরং বাড়তিখরচ আছে। তবে আস্থার জায়গাটা অনেক বড়।
দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ সিনেমায় জেমস বন্ড এক দৃশ্যে বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকের ম্যানেজারকেই যদি বিশ্বাস না করি তাহলে এই দুনিয়ায় আর কাকে বিশ্বাস করব।
অন্যদিকে, আর ফরাসি লেখক ও দার্শনিক ভলতেয়ার ১৭৯৪ সালে লিখেছিলেন, তুমি যদি একজন সুইস ব্যাংকারকে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিতে দেখ, তাহলেও তাকে অনুসরণ কর, নিশ্চিত জেনো সেখানে অবশ্যই মুনাফা করার মতো কিছু আছে।
বর্তমান বিশ্বে সুইজারল্যান্ড নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পর্যটকদেরও পছন্দের দেশ। আবার গোপন অর্থ রাখার দেশও সুইজারল্যান্ড। সুইস ব্যাংকের কুখ্যাতি বা সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। তবে এখনো গোপন অর্থ রাখার অন্যতম নির্ভরযোগ্য জায়গা সুইস ব্যাংক। জেনে রাখা ভালো, সুইস ব্যাংক একক কোনো ব্যাংক নয়, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোকেই সুইস ব্যাংক বলা হয়।
সুইস ব্যাংক ব্যবস্থার শুরু
সুইস ব্যাংক ব্যবস্থায় গোপনীয়তার ইতিহাস ৩০০ বছরেরও পুরোনো। সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের অভিজাত শ্রেণির সম্পদ রক্ষা করার লক্ষ্য থেকে এর যাত্রা শুরু।
১৭১৩ সালে দ্য গ্র্যান্ড কাউন্সিল অব জেনেভা প্রথম ব্যাংক গোপনীয়তার আইন প্রণয়ন করেছিল। সুইজারল্যান্ড সীমান্তের এক পাশের দেশ ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো ছিল মূলত খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্টদের দখলে। ফলে ক্যাথলিকরা সুইস ব্যাংকগুলোতেই অর্থ রাখত। এমনকি ফ্রান্সের সে সময়ের ক্যাথলিক রাজাও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখতেন।
এর আগে ১৭৮০ সালের দিকে সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ বিমার আওতায় আনা হয়। এতে তাদের আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতি আস্থা আরও বাড়ে। ১৮১৫ সালে সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা পেলে সুইস ব্যাংকে অর্থপ্রবাহ অনেক বেড়ে যায়।
গোপনীয়তার আইন কীভাবে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মূলত সুইস ব্যাংকের ভাগ্য বদলে যায়। যুদ্ধ মানেই অনিশ্চয়তা আর অর্থনৈতিক সংকট। এ যুদ্ধের সময়ই ফ্রান্সের অভিজাত ধনিক শ্রেণি সুইস ব্যাংকে বেশি করে অর্থ রাখা শুরু করে। যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহে ইউরোপের অনেক দেশই নতুন নতুন যুদ্ধকর আরোপ করেছিল। এই কর ফাঁকি দিতেই ইউরোপের দেশগুলো থেকে ধনীরা সুইস ব্যাংকে ভিড় বাড়ায়। কারণ, সবাই মনে করতেন সুইস ব্যাংক তাদের নাম প্রকাশ করবে না।
সুইস ব্যাংক গোপনীয়তা রক্ষার মূল আইন করে ১৯৩৪ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের অনেক দেশই চরম আর্থিক সংকটে পড়েছিল। অতিমূল্যস্ফীতির কারণে জার্মানরা ছিল বেশি বিপদে। এ সময় ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো নিজ দেশের ধনীদের কর ফাঁকির তদন্ত শুরু করলে বিপাকে পরে সুইস ব্যাংকগুলো।
এর আগে, ১৯৩২ সালে ফরাসি পুলিশ দুই সুইস ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ, তারা প্যারিসের উচ্চ মহলকে কর ফাঁকিতে সহায়তা করছেন। পুলিশ তাদের কাছ থেকে শতাধিক প্যারিসবাসীর তালিকা জব্দ করে, যারা কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছিলেন।
সুইস ব্যাংক কীভাবে তথ্য গোপন রাখে
সুইস ব্যাংকগুলোর রমরমা ব্যবসার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে এর গোপনীয়তা। সেই গোপনীয়তা হুমকির মধ্যে পড়লে সুইস ফেডারেল অ্যাসেম্বলি আইনটি সংশোধন করে। নতুন আইনে গোপনীয়তা ভঙ্গকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়। এ জন্য জরিমানা ও ছয় মাসে জেলের বিধান রাখা হয়।
আরও পরে তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। এর আগে ব্যাংকের গ্রাহকের তথ্য ফাঁস দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। নতুন এই আইনকে একটি মাইলফলক হিসেবেই মনে করা হয়। সুইস ব্যাংকিং আইনের ধারাটি বিশ্বব্যাপী আর্টিকেল ৪৭ নামে পরিচিত। ভেতরের কেউ (হুইসেল ব্লোয়ার) বা সাংবাদিকেরাও যদি তথ্য ফাঁস করেন তাহলেও তাঁরা এই আইনে দোষী হবেন। সুইজারল্যান্ড এই আইন নিয়ে এখনো গর্ব করে। চলতি বছরেই মে মাসে সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি ও করসংক্রান্ত সংসদীয় সাবকমিটি এই আইন বজায় রাখার পক্ষে ভোট দিয়েছে। এর আগে ১৯৮৪ সালে এ নিয়ে গণভোট হলে আইনটি সংশোধনের বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ৭৩ শতাংশ।
এক গৃহযুদ্ধের পরে ১৮৪৮ সালে গঠিত হয় সুইস ফেডারেশন। শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক কাঠামো দেশটিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়, যা ব্যাংকের গোপনীয়তার নীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া সুইস ব্যাংকব্যবস্থা যথেষ্ট স্থিতিশীল, দেশটির মুদ্রা সহজে রূপান্তরযোগ্য এবং মূল্যস্ফীতির হারও কম। এই সবই সুইস ব্যাংকগুলোর সাফল্যের বড় কারণ।
অ্যাডলফ হিটলারেরও পছন্দ সুইস ব্যাংক
জানা যায়, অ্যাডলফ হিটলারও ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডে (ইউবিএস) ১১০ কোটি রেইচমার্ক (সে সময়ের জার্মানির মুদ্রা, ১৯৪৮ সালে তা বদলে ডয়েসমার্ক হয়) রেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিদের সম্পদ উদ্ধারে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে চাপ বাড়ে সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর। এর ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে হিটলারের জমা রাখা অর্থ ফেরত চায়। ইউবিএস ৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ফেরতও দেয়।
এমএমএ/