বেতন নয়, নতুন চাকরিপ্রত্যাশীকে এনে কমিশন আদায় করাই চাকরি!
চাকরি করতে আগ্রহীরা টাকার বিনিময়ে যোগ দেওয়ার পর জানতে পারে বেতন নয়, নতুন চাকরি প্রত্যাশীকে এনে কমিশন আদায় করাটাই তাদের চাকরি। এমন সব বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে সিনথিয়া সিকিউরিটি সার্ভিস নামের এক প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলছে, এই প্রতিষ্ঠানটি চাকরির নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছিলো। এভাবে চাকরি প্রত্যাশীর কাছ থেকে অভিনব প্রতারণায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
র্যাব জানায়, রাজধানীর উত্তরখান এলাকা থেকে প্রতারণা করে বিপুল সংখ্যক চাকরি প্রত্যাশীর অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের ৭ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১। চাকরি দেওয়ার নামে ডিজিটাল প্লাটফর্মে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে আসছিল উত্তরখানের নামসর্বস্ব সিনথিয়া সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামক এই প্রতিষ্ঠান। তারা অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ পদে জনবলের জন্য আকর্ষণীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারণা করতো।
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের কোম্পানি আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই এবং সরকারি অনুমোদন বা রেজিস্ট্রেশনও নেই। এরপরও তারা দীর্ঘদিন ধরে এসব কাজ করে আসছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- এমএলএম প্রতারক চক্রটির এমডি সামসুন্নাহার ওরফে মায়া, জিএম মো. জুয়েল ভূইয়া, ডিজিএম কামরুজ্জামান ওরফে ডেনিস, রিসিপশনিস্ট ফারহানা ইয়াছমিন ওরফে সুবর্ণা আক্তার, মার্কেটিং অফিসার মেহেদী হাসান, আল মামুন ওরফে মাসুদ ও তাজবির হাসান ওরফে লোহান। এসময় তাদের কাছ থেকে ৫টি ভুয়া নিয়োগপত্র, ৮০টি জীবন বৃত্তান্ত ফরম, ১ বক্স ভিজিটিং কার্ড, ১টি মানি রিসিট বই, ১০১টি ভর্তির ফরম ও অঙ্গীকারনামা, ২টি সিল, ১৫টি আইডি কার্ড, ৩টি রেজিস্টার, ৮টি মোবাইল ফোন, ৮ পাতা চাকরি বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট এবং নগদ ২০ হাজার ৪ শত টাকা জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, সামসুন্নাহার মায়া ও জুয়েল ভূইয়া একটি সংঘবদ্ধ এমএলএম প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। সামসুন্নাহার মায়া ২০২০ সালে রাজধানীর ঢাকার দক্ষিণখান থানার মধ্য আজমপুর, সংগ্রামী সরণী রোডে বি এলার্ট সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডের মার্কেটিং অফিসার পদে চাকরি করতো। পরে গত ৮ মাস ধরে 'সিনথিয়া সিকিউরিটি সার্ভিস লি.' নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা শুরু করে এবং চাকরি প্রত্যাশীদের টার্গেট করে প্রতারণা করে।
সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন।
লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর র্যাব-১ ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে র্যাব-১ এর একটি দল ডিএমপির উত্তরখান থানাধীন আটিপাড়া বাজারের ‘মা মনোয়ারা সুপার মার্কেটের’ ৪র্থ তলায় সিনথিয়া সিকিউরিটি সার্ভিস লি. এর অফিসে অভিযান পরিচালনা করে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল প্লাটফর্মে চাকরি দেওয়ার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসছিল। অনলাইনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একটি চক্র প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। তারা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে তাদের এমএলএম কোম্পানির বিভিন্ন প্রজেক্টে সাধারণ মানুষকে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করে আসছিলো।
অভিযুক্তদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ এমএলএম প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। সিনথিয়া সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামে তারা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো। প্রতারক চক্রটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। তাদের কোম্পানিতে ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এবং তাদের অধীনে বিভিন্ন অফিস, ব্যাংক, এটিএম বুথ, থ্রি স্টার অ্যাপার্টমেন্ট, গার্মেন্টস-টেক্সটাইল, মিল-ফ্যাক্টরি, বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্ট, মেট্রোরেল হেড অফিস, চায়না প্রজেক্টসহ আরও কিছু জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে কিছু কর্মচারী নিয়োগের জন্য তাদের ফেসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দিত।
তাদের অফিস থেকে চাকরি প্রার্থীদের মোবাইলে ফোন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট তারিখে অফিসে এসে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য বলা হয়। নির্দিষ্ট তারিখে চাকরি প্রার্থীরা ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য অফিসে আসার পর তাদের কাছ থেকে ভর্তি ফরম, ট্রেনিং এবং আইডি কার্ড বাবদ ১২ হাজার ৫০০ টাকা জামানত আদায় করা হতো। তাদের জানানো হতো পদ অনুসারে তাদের মাসিক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। পরে সিকিউরিটি অফিসে যোগ দিলে তাদের নিয়োগপত্রে উল্লেখ করা হতো প্রতি মাসে নতুন নতুন চাকরি প্রার্থী সংগ্রহ করতে হবে এবং নতুন প্রার্থী সংগ্রহের ভিত্তিতে কমিশন হিসেবে তাদের বেতন দেওয়া হবে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, প্রতারণার বিষয়ে বুঝতে পেরে জামানতের টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন টালবাহানা করতো এবং টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানাতো। এভাবে অভিযুক্তরা গত ৬ মাসে প্রায় ৭০০/৮০০ জন চাকরি প্রার্থীকে তাদের কোম্পানির নিয়োগ ফরম পূরণ করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা। গত ৮ মাস ধরে সিকিউরিটির গার্ড নিয়োগের নামে কোম্পানি চলছিল। কিন্তু তারা কোনো সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেয়নি।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/এএস