চকরিয়ায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু
পিকআপের ফিটনেস-রুট পারমিট নেই, চালকের নেই লাইসেন্স
পিকআপ চালক সাইফুলের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, তবুও তিনি দুই বছর যাবৎ পিকআপ, চাঁন্দের গাড়ী ও তিন টনের ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন। চকরিয়ায় দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে তিনি পিকআপটি দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিভিত্তিতে চালানো শুরু করেন। কুয়াশা ও বেপরোয়া গতির কারণে চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একই পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে চাপা দেন। ওই ঘটনায় মারা যান পাঁচ সহোদর। ঘটনার পর মালিকের নির্দেশনায় তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত কক্সবাজারের চকরিয়ায় মৃত বাবার শ্রাদ্ধ শেষে ফেরার পথে বেপরোয়া গতিতে চলমান পিকআপের চাপায় পাঁচ সহোদরের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় ঘাতক পিকআপের চালক সহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট নামক স্থানে একটি পিকআপের চাপায় একই পরিবারের ৪ ভাই অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫) চম্পক সুশীল (৩০) ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন অপর সহোদর স্বরণ সুশীল (২৪)।’
ওই দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তাদের সহোদর রক্তিম সুশীল এবং বোন হীরা সুশীল। বর্তমানে রক্তিম সুশীল চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
স্থানীয়সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ জানুয়ারি নিহতদের পিতা সুরেশ চন্দ্র সুশীলের বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে পূজা শেষ করে তারা ৯ ভাই-বোন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাট বাজারের কাছে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন।
এ সময় ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজারমুখী বেপরোয়া গতিতে চলমান ওই পিকআপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মূলসড়ক থেকে নেমে গিয়ে তাদের চাপা দেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
ওই ঘটনায় নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল (২২) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পিকআপ চালককে আসামী করে কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় সড়ক পরিবহন আইনে ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৫। ওই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদরদপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫ এর অভিযানে গতকাল শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ঘাতক পিকআপ চালক সহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে গ্রেফতার করা হয়। সাইফুল বাড়ি বান্দরবান লামার আলী জাফরের ছেলে।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার পিকআপ চালক সাইফুল নিহতদের গাড়ি চাপা দেওয়ার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
গ্রেপ্তার সাইফুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টায় তারেক ও রবিউল নামক দুইজনসহ চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে সবজি বোঝাই পিকআপ নিয়ে তিনি রওনা করেন। রাস্তায় অধিক কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও চালক সাইফুল দ্রুত কক্সবাজার পৌঁছে সবজি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেপরোয়া গতিতে পিকআপটি চালাচ্ছিল।
সাইফুল র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি ঘন্টায় প্রায় ৬৫-৭০ কিলোমিটার গতিতে চালাচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় চালক গাড়ি থামানোর জন্য ব্রেক করলেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি প্রায় ১০০ ফুটের মতো সামনে চলে যায়। পরবর্তীতে চালক পিকআপ থেকে নেমে নিহতদের দেখতে এলেও গাড়ির মালিকের ছেলে তারেকের নির্দেশে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
লাইসেন্স নেই তবুও সাইফুলের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং
গ্রেপ্তার পিকআপ চালক সাইফুলের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও দীর্ঘ দুই বছর যাবত সে পিকআপ, চাঁন্দের গাড়ি ও ৩ টন ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরণের গাড়ি চালানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে তিনি পিকআপটি মালিকের কাছ থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরির ভিত্তিতে চালানো শুরু করেন। এর আগে তিনি বান্দরবানের লামাতে একটি রাবার বাগানে চাকরি করতেন।
দুর্ঘটনার পর গ্রেপ্তার সাইফুল মালুমঘাট বাজারের একটি স্থানে গাড়িটি থামিয়ে মালিককে ফোন করে দূর্ঘটনার বিষয়টি জানান। গাড়িটির মালিক তাকে পিকআপটি পরবর্তী কোনো এক স্টপেজে রেখে লোকাল বাসে করে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রেপ্তার সাইফুল ডুলাহাজরায় এসে পিকআপটি রাখেন এবং লোকাল বাসে করে চকরিয়া গিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করেন। বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন শেষে ঢাকায় আসেন এবং রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন।
পিকআপটির ফিটনেস-রুট পারমিটও মেয়াদোত্তীর্ণ
পিকআপের মালিক চকরিয়ার মাহামুদুল করিম। তিনি মূলত সবজি পরিবহনের ব্যবসা করেন। তিনি চকরিয়ার সবজির আড়ৎ থেকে কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী এলাকায় সবজি সরবরাহ করতেন। তার ছেলে তারেক সবজি সরবরাহের তদারকি করতেন এবং ভাগ্নে রবিউল তারেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিনি ২০১৬ সালে পিকআপটি ক্রয় করেন। গত ৪ বছর ধরে পিকআপের ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন এবং গত ৩ বছর ধরে রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। দুর্ঘটনার পর পিকআপের মালিক, তার ছেলে তারেক ও ভাগ্নে রবিউল আত্মগোপনে রয়েছেন।
এই ঘটনার সঙ্গে পূর্বশত্রুতার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন কোনো তথ্য মেলেনি। অধিক কুয়াশা ও অতিরিক্ত গতির কারণে মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে চালক সাইফুল দূর থেকে কাউকে লক্ষ্য করতে পারেননি। অধিক গতির কারণে কাছাকাছি এসে ব্রেক করেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি পিকআপ। গ্রেফতার সাইফুলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন।’
এসএ/