দেশজুড়ে সক্রিয় প্রতারক চক্র
পাল্টে গেছে প্রতারণার কৌশল। প্রতারকরা বিভিন্নভাবে মানুষকে ঠকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। কেউ কেউ আবার একইভাবে বারবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে এ প্রতারক চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন কৌশলে কাজ করছে এসব চক্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্রে জানা যায়, মধ্যবিত্তরা বেশিরভাগ ছোট ছোট প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ঝামেলার ভয়ে তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে আগ্রহী নয়।
ঢাকাপ্রকাশের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতারকদের প্রতারণার ভিন্ন কৌশল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল পরিবর্তন করে একের পর এক প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা।
এদিকে, প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অতিরিক্ত লোভের কারণে প্রতিনিয়তই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার শাহীন সিনেমা হলের স্টাফ সুজন মিয়া। তিনি বলেন, ‘একটি পত্রিকার মাধ্যমে গাজীপুর সাইনবোর্ড এলাকায় চাকরির জন্য যাই। সেখানে গিয়ে তিন দিনের ট্রেনিংয়ের নামে ১০ হাজার টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছি। যদিও টাকা ট্রেনিং শেষে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু দেয়নি।’
যশোর জেলা থেকে পত্রিকার চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে পরিবারের সঙ্গে রাগারাগি করে ঢাকায় আসেন রোকন হোসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে নায়ক-নায়িকার বডিগার্ড বানানোর কথা বলে প্রতারক নাইট গার্ডের চাকরি দিয়েছে। এখন কোথাও যেতে পারছি না, বাধ্য হয়ে ৪ মাস ধরে এই চাকরি করছি।’
নেত্রকোনা জেলার মো. বাঁধন হোসেন সবেমাত্র এসএসসির গণ্ডি পার হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছেন অভাবের সংসার। মনে মনে ভেবেছেন সংসারের হাল ধরবেন। সেজন্য পত্রিকা দেখে চাকরি করতে এসে ৪০ হাজার টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পুলিশের কাছে গেলেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রতারক চক্র তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল পদক্ষেপ নেবে এ ভয়ে সে কোথাও যায়নি।
পত্রিকাতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই মাত্র এসএসসি পাসে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে জামালপুরের সুমন পারভেজ ছুটে আসেন গাজীপুরের বোর্ডবাজারে একটি অফিসে। অফিস চকচক দেখে তার বেশ ভালো লাগে। ৫ দিন ট্রেনিংয়ের নামে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে বলে প্রতারক আজিজ নামের এক ব্যক্তি। ভালো অফিস দেখে গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা এনে জমা দেন সুমন। ট্রেনিংয়ের নামে তাকে সাভারে পাঠানো হয়। এর পর থেকে আজিজ আর ফোন ধরেন না।
এদিকে, রাজধানীর আশপাশে বাসা-বাড়ি ভাড়া নিয়েও গড়ে উঠছে প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্যরা। চকচকে অফিস, আর চটকদার বিজ্ঞাপনকে পুঁজি করে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল ও অল্পশিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের আকৃষ্ট করছে। পরে এসব ছেলে-মেয়েদের ফাঁদে ফেলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
এমন প্রতারণার শিকার হওয়া হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে। বাবা ভ্যান চালিয়ে আমাদের তিন ভাই-বোনকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। আমিই সবার বড়। চাকরির খোঁজ পেয়ে গ্রাম থেকে আসি ঢাকাতে। দুই দিন ট্রেনিং করার পর আমাকে বলে জামানত হিসেবে ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। এবং সেটি তিন মাস পর ফেরত দেয়া হবে। টাকা জমা দেওয়ার পর এখন আর ফেরত দিচ্ছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাকরির বিষয়টি বাড়িতে জানালে একটা গরু বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা দেয়। আমি সেই টাকা দেওয়ার পর তাদের আচরণ পাল্টে গেছে। কোনো কাজ নেই। সারাদিন শুধু ট্রেনিং করায় আর বলে এখানে মানুষ নিয়ে আসাটাই চাকরি। বুঝতে পারলাম প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
বিভিন্ন প্রতারণার কৌশলে কাজ করে প্রতারক চক্র
সংসারে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন আবুল হোসেন, এজন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ছুটে আসেন ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায়। সেখানকার একটি ‘সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডে’ থাকা-খাওয়া ট্রেনিং বাবদ অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে প্রতারিত হন তিনি। প্রতারণার শিকার হন একই এলাকার আল আমিন ও ফরহাদ নামের দুই যুবক।
গয়না পাওয়ার প্রতারণাও বেড়েছে
আমমেদ রিকশা করে শাহবাগ থেকে পল্টনে শপিং করতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক রিকশাচালক বললেন এই গয়নাটি পেয়েছি স্যার। এক ভরি হতে পারে। ৫ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন তিনি। স্বর্ণের দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখেন এটি সোনা নয়। জীবনে প্রথম পড়েন প্রতারণায়।
আরেক ব্যক্তি রবিন প্রতারণার শিকার হয়ে বলেন, গহনা ভেবে চেইন গিনেছি ৩ হাজার টাকা দিয়ে, পরে দেখি এটা সিটি গোল্ড।
ডলার প্রতারক চক্র
বনানীতে হাঁটছে জেরিন জারা নামের এক যুবতী। পাশে থাকা এক লোক বলেন তার কাছে ৩০ ডলার আছে। তার ইমার্জেন্সি টাকা দরকার, মাত্র ১ হাজার টাকা দিলেই হবে। অনেক টাকা লাভের আশায় তিনি ৭০০ টাকা দিয়ে সেটি ক্রয় করে।পরে ওই লোক বলেন, এটা জাল ডলার ফেরত দেন না হয় পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেব। পরে জেরিন রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে আসে ওই ডলার।
এসব প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জিসানুল হক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অনলাইনে নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরির নামে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এমন অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, কিছু প্রতারককে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে আগের চেয়ে প্রতারণা কিছুটা কমেছে। সাধারণ এই চক্রের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নিত্যনতুন কৌশল পরিবর্তন করে প্রতারণা করছে।’
প্রতারণার বিষয়ে র্যাবের সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘অনেক প্রতারককে আমরা আইনের আওতায় এনেছি। প্রতারণা রোধে সব সময় র্যাব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইতিমধ্যে সারা দেশে প্রতারণা রোধে কাজ করছে র্যাব। প্রতারণার কোনো অভিযোগ পেলে র্যাব সেটি আমলে নিয়ে প্রতারণ চক্রকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে।’
এ সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল আসাদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘প্রতারকরা একেক সময় একেক কৌশলে কাজ করে। ইতিমধ্যে অনেক প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় এনেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। তারা সাজা ভোগের পর বেরিয়ে এসে আবার নতুন করে প্রতারণার কাজে যুক্ত হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত তারা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের যে কাযর্ক্রম তা অব্যাহত আছে। আমরা বিভিন্ন সময় এদের ধরতে অভিযান চালায়। তা ছাড়া যদি কেউ এসব অভিযোগ নিয়ে আসে পুলিশ সেটা আমলে নিয়ে কাজ করে। এর বাইরে ও আমাদের ডিবি পুলিশের গোয়েন্দা টিম প্রতারণা রোধে কাজ করে যাচ্ছে।’
এমকে/এসএ/