সাঁড়াশি অভিযানেও বন্ধ হয়নি ইয়াবা কারবার
বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানিতেও বন্ধ হয়নি ইয়াবা পাচার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান এখনো চলছে। বরং পাচারকারীরা নিত্য-নতুন কৌশলে কাজ করছে। সম্প্রতি ইয়াবার বেশ কিছু চালান ধরা পড়েছে যেখানে পাচারকারীরা লোক ভাড়া করে তাদের ইয়াবা গিলিয়ে বা পায়ুপথ দিয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে ইয়াবা পাচারের কাজ করেছে।
সংশ্লিষ্ট বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০১৮ সালের ৪ মে একযোগে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সেই অভিযানে র্যাব, পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রায় ৪০০ মাদক কারবারি নিহত হন।
সে সময় গ্রেপ্তার হন ২ লক্ষাধিক মাদক কারবারি। কিন্তু তারপরও বন্ধ করা যায়নি মাদক ব্যবসা। অনেক মাদক কারবারি জেল থেকে বের হয়ে আবারও নতুন করে কৌশলে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলেও সূত্র জানায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে জানা যায়, ২০১৮ সালের মের পর থেকে থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পযর্ন্ত প্রায় শতাধিক মাদককারবারি নিহত হন।
গোয়েন্দা তথ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশ ইয়াবাসেবী। ইয়াবার কারবারের সঙ্গে কয়েক শ্রেণির মানুষ জড়িত। এরমধ্যে সাংবাদিক, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদসহ অনেকেই আছেন!
ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিল। সেই অভিযানে মাঠপর্যায়ের মাদক কারবারিরা ধরা পড়লেও বড় কারবারি কিংবা পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অভিযানকালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ওঠে।
অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নতুন করে ইয়াবা কারবারিদের নাম প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে মোট ২৫৫ ইয়াবা কারবারির তালিকা নিয়ে হইচই চলছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দাবি, এই তালিকায় উঠে এসেছে সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদসহ অনেকের নাম। তবে এটি এখনো ফাইনাল নয় ভেতরে ভেতরে ঘটনার তদন্ত চলছে।
বেশ কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকা থেকে পেটের ভেতর ইয়াবা পাচারকালে রুবেল হোসেন (৩৫) নামে এক ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইয়াবার বিষয়টি রুবেল তার স্ত্রীকে বলেন। এরপর তাকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে রুবেলের বিষয় নিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, তার পেট থেকে ইয়াবার প্যাকেটগুলো বের করার চেষ্টা চলছে। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আর কয়েকদিন পলিথিনসহ ইয়াবা পেটে থাকলে তিনি মারা যেতেন।
অসুস্থ রুবেল হোসেনের স্ত্রী সাহিদা বেগম বলেন, আট দিন আগে পেটের ভেতর করে পাচার করার জন্য ১৭ প্যাকেট ইয়াবা কুমিল্লা থেকে গিলে ফেলেন। যার মধ্যে ৪০টা করে ইয়াবা থাকে বলে তিনি জানান। পরে অসুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসেন। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দুজন প্রতিবেশীর সহায়তায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। এখনো তার চিকিৎসা চলছে।
সাহিদা বেগম আরও বলেন, আমার মতো কেউ যেন বিপদে না পড়ে। ইয়াবা আমার ঘর সংসার সব শেষ করে দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ইয়াবার পাচারকারীরা বিভিন্ন কৌশলে কাজ করে। রুবেলের মতো অসংখ্য মানুষ এমন কাজ করছে তবে তারা 'চুনোপুঁটি'। সরকারি বাহিনীর দাবি, মাদক কারবারিরা ইয়াবা গিলিয়ে বা পায়ুপথ দিয়ে শরীরের ভেতরে রেখে পাচারের কাজ করে। এজন্য মূলত মাদক ব্যবসায়ীদের ধরা যায় না। ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে সেবনকারী ও অন্যদের কাজে লাগিয়ে গোপনে কাজ করে। এজন্য তাদের নাম পাওয়া কষ্টকর হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, একাধিক পাচারে বাহক হিসেবে ব্যবহার হওয়া গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ঢাকায় চালান নিয়ে আসতে একেকটি ইয়াবা বড়ির জন্য অনেক টাকা করে দেওয়া হয়।
অবশ্য ইয়াবা পাচারের এমন সব বিভিন্ন কৌশল নিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবা পাচারের ব্যক্তির যেকোনো সময় মৃত্যুও হতে পারে। কারণ, মানুষের পাকস্থলিতে খাবার হজমের জন্য যে রস থাকে, সেটি ইয়াবা বড়িকেও গলিয়ে ফেলতে পারে। তা ছাড়া পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবা পচে অনেকেরই মৃত্যু হতে পারে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক সুদ্বীপ রঞ্জন বলেন, পেটের মধ্যে অতিরিক্ত ইয়াবা বা অন্যান্য মাদক জাতীয় যে কোনো জিনিস বেশি সময় ধরে থাকলে বা হজম না হলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে ৯৮ শতাংশ। এভাবে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুও হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। আর পায়ু পথ দিয়ে ক্রমাগত এগুলো বের করতে থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
তিনি আরও বলেন, ইয়াবা বড়ি কয়েকটা পেটের ভেতর গলে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত।
মাদকাসক্তদের মাঝে নব্বই এর দশকে জনপ্রিয় ড্রাগ ছিল হেরোইন। আর আশির দশকে ছিল ফেনসিডিল, যা নব্বই এর দশকেও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলাদেশে ইয়াবা নামক একটি ট্যাবলেট নেশার উপকরণ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাবিষয়ক সাময়িকীতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের হনোরারি মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুল ইসলামের একটি গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে, বর্তমান মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশ ইয়াবাসেবী। গবেষকরা বলছেন, যার অধিকাংশই অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে। বিভিন্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যারা চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। হেরোইন ও ফেনসিডিলের চল এখনো আছে। কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে। ইয়াবা, হেরোইন ও ফেনসিডিলের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি ঘোষণা করেছে। এরপরও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে মাদকের চোরাচালান। সরকারি একটি পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, শুধু কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবা বড়ি উদ্ধার চার বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
জানা গেছে, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ২০১৯ সালে কক্সবাজারে ১ কোটি ৭৭ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০২১ সালে যেখানে ২৪ কেজি আইস উদ্ধার হয়েছিল, গেল বছর সেখানে ১৯২ কেজি আইস উদ্ধার হয়েছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১০১ মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে মাদক চোরাচালান কমবে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটেছে। সম্প্রতি ওই মাদক কারবারিদের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদক ব্যবসার সর্বোচ্চ শাস্তি যেখানে মৃত্যুদণ্ড, সেখানে তাদের দেড় বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ৮৩ জনই পলাতক। পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ৪ ভাইসহ ১২ জন নিকটাত্মীয়। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা তাদের এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি।
এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, নতুন প্রকাশিত ২৫৫ ইয়াবা কারবারির তালিকা নিয়ে হইচই চলছে। তালিকায় উঠে এসেছে সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদসহ অনেকের নাম। মন্ত্রী বলেন, তালিকায় নাম থাকলেই যে ইয়াবা কারবারি হয়ে যাবে বিষয়টি এমন না। সেই জন্য দ্রুত তালিকা যাচাই-বাছাই করে ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যদের। তা ছাড়া ইয়াবাসহ সকল প্রকার মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। তবে পুলিশের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও দমতে এগিয়ে আসতে হবে।
কেএম/এসএন