বছরজুড়ে দুদকের যত আলোচনা
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বেশ কিছু ঘটনা ছিল প্রায় বছর জুড়ে আলোচনায়। দুদকের কর্মকর্তা শরিফকে চাকরিচ্যুত করার পর ঘটনাটি আলোচনায় আসে। বিদায়ী বছরে দুদকের গণশুনানি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশের ফলোআপ নেই। একই সঙ্গে বছরজুড়ে বেড়েছে অভিযোগ, কমেছে মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিল।
পিকে হালদার
আর্থিক খাতের লুটেরা প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ও তার সহযোগীদের ২০২২ সালের ১৫ মে ভারতে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের করে দুদক। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় হলেও, এখনো সেটা করা যায়নি।
বালুখেকো সেলিম
চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান বালুখেকো হিসেবে পরিচিত সেলিম খানসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। তা ছাড়া ব্যাংকার, সরকারি কর্মচারীসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, মামলা ও অভিযোগপত্র দিয়েছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে মহিলা যুবলীগ সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক কাউন্সিলর আলেয়া সারোয়ার ডেইজি এবং বিমান, ওয়াসাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বছর পার করেছে সংস্থাটি। তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের এমডিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ কর্তাদের তলব করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন বড় কোনো সাফল্য নেই দুদকের। বছর শেষে (২৬ ডিসেম্বর) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তার স্ত্রীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে প্লট জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে দুদক।
দুদকের সফলতা ও ব্যর্থতা
বিআরটিএ, ওয়াসা, তিতাস, রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি ও পাসপোর্ট অফিসসহ সেবাখাতে ঘুষ দুর্নীতি বাড়লেও বিমান অফিস, তিতাসসহ এক বছরে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় দুদক। এসব প্রতিষ্ঠানে সাড়াশি অভিযান ছিল না বললেই চলে। দুদকের ফাঁদ অভিযানও উল্লেখ করার মতো নয়। হটলাইনের মাধ্যমে নামমাত্র কিছু অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে গণশুনানি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশও তেমন নেই বললে চলে। প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা নিয়েও।
দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট হচ্ছে। টাকা পাচারের ঘটনা বেড়ে চলছে। অথচ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দুদকের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, এ আইনের সব অপরাধের তদন্তভার না দেওয়া। এ ছাড়া মানিলন্ডারিং আইনের ২৭ অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধের অনুসন্ধান করতে পারে দুদক। আইন সংশোধন করে আরও ছয়টি অপরাধের তদন্তভার চাইলেও সেটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আর্থিক বিভাগের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে আটকে আছে।
উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত
২০২২ সাল, এই এক বছরে দুদকে অভিযোগ বাড়লেও অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা ও চার্জশিট কমেছে। বরং বিধিমালা ভঙ্গসহ একাধিক অভিযোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতি, এ ঘটনার প্রতিবাদে দুদক কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ, চাকরি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে মামলা, বিএনপিসহ রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কমিশনের অনড় সিদ্ধান্ত সবকিছু মিলিয়ে বছরটি আলোচনার ঝড় তোলে। দুদকের শরীফকাণ্ডই ছিল ২০২২- এর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
১১৬ আলেম ও ইসলামি বক্তার দুর্নীতিতে একটি শ্বেতপত্র জমা
তা ছাড়া দেশের ১১৬ আলেম ও ইসলামি বক্তার দুর্নীতির তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে গত ১১ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি শ্বেতপত্র জমা দেয় গণকমিশন। গণকমিশনের এই তালিকা নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে। পরবর্তীতে ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত হলেও সেটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পদের হিসাবের অনুসন্ধান
দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজনদের সম্পদের হিসাব নেওয়া, জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। যা ফলাও করে প্রচারও করা হয়। কিন্তু দুদকের মামলায় গত পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ৯৭ শতাংশের বেশি ছোট পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধি। এ তালিকায় হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া উচ্চ পর্যায়ের সরকারি আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী কেউ নেই বললে চলে।
বেড়েছে অভিযোগ, কমেছে অনুসন্ধান-মামলা
দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দুদকে ১৮ হাজার ১৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। ডিসেম্বর মাসে অভিযোগের সংখ্যা আরও বাড়বে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ৮৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে কমিশন, যা মোট জমা হওয়া অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এসব অভিযোগের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে ৩ হাজার ৬০টি অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ১৪ হাজার ১১৯টি অভিযোগ কোনো কার্যক্রমের জন্য সুপারিশ করা হয়নি।
চলতি বছর দুদকে আসা মোট অভিযোগ থেকে মাত্র সাড়ে চার শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়েছে। দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে মোট অভিযোগের ৭৮ শতাংশই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ২০২১ সালের দুদকে মোট ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ জমা পড়ে। অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় ৫৩৩টি।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ মাসে দুদক ৩৫৪টি অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩১২টি অভিযোগ। সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি ৮৯টির, এফআইআর ২৭৬টি, চার্জশিট ১৬২টি আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে ৭৮টি অভিযোগের।
দুদকে বর্তমানে অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮টি অভিযোগ। চলমান মামলা আছে ১ হাজার ৬৯৯টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলা আছে যথাক্রমে ৭২৪ ও ১৫৭টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলার শতকরা হার ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থ-পাচার, ব্যাংক-বিমা সংক্রান্ত অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব অনুসন্ধান ও মামলা চলছে।
অভিযোগের তুলনায় অনুসন্ধান কম হওয়ার কারণ জানিয়ে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক জানান, সব অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারি না। কারণ, যেসব অভিযোগ আসে তার বড় অংশই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। দুদকের সেসব অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার নেই।
কেএম/এসএন